
ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী জেলার অন্যতম বৃহৎ উপজেলা বাগমারা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমসাময়িক পরিবর্তনের এক অনন্য সাক্ষ্য বহন করে। প্রাচীন রাজত্ব, ধর্মীয় ঐতিহ্য, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং আধুনিক উন্নয়ন—সব মিলিয়ে বাগমারা একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ।
নামকরণ ও প্রাচীন ইতিহাস
বাগমারা নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন লোককথা প্রচলিত আছে। এক মতে, একসময় এই অঞ্চল ছিল গভীর বনভূমিতে পরিপূর্ণ, যেখানে বাঘের উপদ্রব ছিল ব্যাপক। স্থানীয় বাসিন্দারা বাঘ হত্যা করে এলাকা নিরাপদ করে তোলেন, এবং সেই থেকেই এলাকার নাম হয় "বাগমারা"। অন্য মতে, ব্রিটিশ আমলে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে উঠায় এই নামকরণ হয়।
তাহেরপুর: রাজা কংস নারায়ণের রাজধানী
বাগমারার তাহেরপুর অঞ্চল ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার বার ভূঁইয়াদের অন্যতম তাহের খাঁ এখানে রাজত্ব করতেন। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সংঘর্ষে তাহের খাঁ পরাজিত হলে, রাজা কংস নারায়ণ তাহেরপুরের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৪৮২ সালে তিনি উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করেন, যা আজও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত হয়।
প্রশাসনিক কাঠামো ও পৌরসভা
১৯৮৩ সালে বাগমারা উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। পৌরসভা দুটি হলো:
তাহেরপুর পৌরসভাঃ ১৯৯৮ সালের ১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত, ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা। এর আয়তন ১৭.৮৭ বর্গকিলোমিটার এবং সাক্ষরতার হার ৮৭.৩%।
ভবানীগঞ্জ পৌরসভাঃ বাগমারা উপজেলার সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যা
বাগমারা উপজেলার আয়তন ৩৬৬.৩০ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তরে নওগাঁ জেলার মান্দা ও আত্রাই উপজেলা, দক্ষিণে দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলা, পূর্বে নাটোর সদর উপজেলা এবং পশ্চিমে মোহনপুর উপজেলা অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, উপজেলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৩,৫২,৯৬৯ জন।
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
বাগমারায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
ভবানীগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ:পূর্বে ভবানীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ নামে পরিচিত।
তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ: ঐতিহাসিক তাহেরপুর রাজবাড়ির চত্বরে অবস্থিত।
বিপ্রকয়া সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি এলাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয়।
বীরকুৎসা অবিনাশ উচ্চ বিদ্যালয়: ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি এলাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক।
হাজার দুয়ারী: অতীতের এক অমলিন চিহ্ন
বাগমারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘হাজার দুয়ারী’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। স্থানীয় কাহিনী ও পুরান নথিপত্রের মাধ্যমে জানা যায়, হাজার দুয়ারী একসময় এই অঞ্চলের প্রাচীন সাম্রাজ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর স্থাপত্যশৈলী, অসংখ্য নকশা ও শিলালিপির নিদর্শন প্রাচীন বাংলা স্থাপত্যকলার অনন্য সাক্ষর বহন করে।
উক্ত স্থানটি শুধু ঐতিহাসিক মূল্যবোধের নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হয়। আধুনিক সময়ের নাগরিক উন্নয়ন ও অরাজকতার কারণে এখানকার কিছু অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও, সম্প্রতি স্থানীয় সরকার ও সংস্থাগুলোর উদ্যোগে এর পুনর্জাগরণ ও সংরক্ষণের কাজ করা সম্ভব ।
উন্নয়ন ও চ্যালেঞ্জ
সরকারি, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এলাকার উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণে নানা কাজ চলমান রয়েছে। তবে, তাহেরপুর হাটের অব্যবস্থাপনা, যানজট এবং অবৈধ স্থাপনা এই অঞ্চলের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক নিদর্শন: অচিন বৃক্ষ
তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজ চত্বরে অবস্থিত প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো একটি গাছ, যাকে স্থানীয়ভাবে "অচিন বৃক্ষ" নামে সম্বোধন করা হয়। এই গাছটি এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অমলিন প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
বাগমারা উপজেলা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আধুনিক উন্নয়নের মাধ্যমে রাজশাহী জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আলীম