ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গঠনে আলোকবর্তিকা জাবি সায়েন্স ক্লাব

মোঃ মিজানুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ২০:২১, ৩০ জুলাই ২০২৫

বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গঠনে আলোকবর্তিকা জাবি সায়েন্স ক্লাব

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে বিজ্ঞানচর্চার ধারা দীর্ঘদিন ধরে মূলত পাঠ্যবই ও পরীক্ষার সীমানার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নতুন প্রজন্মের হাতে বিজ্ঞানকে আনন্দ, কৌতূহল এবং উদ্ভাবনের এক নতুন ভাষা হিসেবে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্স ক্লাব (JUSC)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে এই সংগঠন গড়ে তুলছে এমন এক প্রজন্ম, যারা যুক্তি ও কল্পনাশক্তিকে একসঙ্গে কাজে লাগাতে শিখছে।

কয়েকজন বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থেকে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সূচনা হয় জাবি সায়েন্স ক্লাবের। শুরুটা ছিল ছোট আকারে, ক্যাম্পাসের ভেতরে বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা ও প্রদর্শনীর আয়োজন দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ক্লাবের কর্মপরিধি বিস্তৃত হতে থাকে—ক্যাম্পাসের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানবোধ জাগ্রত করা, পরীক্ষাভিত্তিক পড়াশোনার বাইরে গিয়ে গবেষণার আগ্রহ তৈরি করা, হাতে-কলমে বিজ্ঞানের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন মূল লক্ষ্য।

দেশের বৃহত্তম ক্যাম্পাসভিত্তিক এই বিজ্ঞান ক্লাবে ৩১ জন কার্যকরী সদস্যসহ নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা ৮৭ জন এবং প্রায় তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। প্রতি মাসে একবার সাধারণ সদস্যগণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকরী পরিষদ সভায় মিলিত হন। তাছাড়া, তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করার জন্য বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ১৭ নং কক্ষে ক্লাবের প্রধান কার্যালয় রয়েছে, যেখান থেকে এর সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠনটি বছরব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিক নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে আসছে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে JUSC-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো ন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্ট এবং ন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াড। ন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াড এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তিনটি বিভাগে প্রতিযোগিতা করে। ফেস্টে ছিল: বিজ্ঞান কুইজ, রুবিক্স কিউব প্রতিযোগিতা, পোস্টার প্রদর্শনী, ওপেন স্পিচ, প্রজেক্ট শোকেস। এছাড়াও, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর আয়োজিত জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড।

‘Committed to exploring the truth’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে তাদের নিরলস চেষ্টায় আজ জাবি সায়েন্স ক্লাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গনে এক পরিচিত ও সম্মানিত নাম, যা 'বাতিঘর' হিসেবে কাজ করে।

এই ক্লাবের স্বপ্ন আগামী প্রজন্মের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক মনন গড়ে তোলা, যাতে তারা ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষাকে শুধু পুস্তকভিত্তিক না রেখে বাস্তবমুখী করে তোলার লক্ষ্যে ক্লাবটি কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

জাবি সায়েন্স ক্লাবের বর্তমান সভাপতি মো. সৌরভ বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সায়েন্স ক্লাব দেশের অন্যতম শীর্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠন, যা জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর কর্তৃক নিবন্ধিত। শুরু থেকেই বিজ্ঞানচর্চায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছি। পরবর্তীতে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি দূর করতে জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াড এবং বিজ্ঞান প্রসারে ন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল নিয়মিত আয়োজন করছি। ক্লাবের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘নিউক্লিয়াস’ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও লেখালেখিকে আরও উন্নত করছে।

গত এক দশকেরও বেশি সময়ে JUSC-এর আয়োজিত প্রতিযোগিতা থেকে উঠে এসেছে শত শত মেধাবী শিক্ষার্থী, যারা দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং বিদেশের উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ পেয়েছে।

ক্লাবের প্রাক্তন সদস্যবৃন্দ ক্যামব্রিজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনসহ বিশ্বের অন্যতম বিদ্যাপীঠগুলোতে গবেষণা করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে গ্রামীণ ও মফস্বলের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা এই ইভেন্টে অংশ নিয়ে বিজ্ঞানের নতুন দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা লাভ করছে—যা অনেকের জীবন বদলে দেওয়ার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞানচেতনা ও সৃজনশীলতার এই যাত্রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্স ক্লাব হয়ে উঠেছে সত্যিকারের এক আলোকবর্তিকা। একটি বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনির্ভর এবং উদ্ভাবনী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এই সংগঠনের নিরলস প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে আরও উজ্জ্বল গন্তব্যের দিকে।

 

রাজু

×