
নানা আয়োজন-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ রবিবার ‘প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে সৃজন, গবেষণা, নেতৃত্বে দেশ ও বিশ্বের পথপ্রদর্শক’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সকাল ১০টায় প্রশাসন ভবন-১ চত্বরে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরারসহ উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান। এসময় প্রাধ্যক্ষবৃন্দ নিজ নিজ হলের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা ও বর্ণিল বেলুন-ফেস্টুন ওড়ানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠান উদ্বোধনের পর এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রায় শিক্ষা উপদেষ্টা, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও কোষাধ্যক্ষসহ আবাসিক হল, ইনস্টিটিউট, বিভাগ ও দপ্তরসমূহ নিজ নিজ ব্যানারসহ অংশ নেয়। শোভাযাত্রার পর অতিথিবৃন্দ সিনেট ভবন চত্বরে বৃক্ষরোপণ করেন।
বেলা ১১টায় সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মতিয়ার রহমান। উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের সভাপতিত্বে এই আয়োজনে আলোচক ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইমেরিটাস এ কে এম আজহারুল ইসলাম।
আলোচনায় অধ্যাপক ইমেরিটাস এ কে এম আজহারুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের আত্মপরিচয় স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতকে। পাশাপাশি চিন্তা করি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশে রাবির এক বিশেষ অবস্থান আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের অনেকেই অধ্যাপনা করেছেন। তাঁরা নিজেরা এবং তাঁদের ছাত্ররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। আগামী দিনগুলোতে সেই ধারা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা উদ্ভাবনমনস্ক গবেষক ও শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতবিদ্য শিক্ষকমণ্ডলী সেই লক্ষ্যে সচেতন হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রাবিতে তাঁর ছয় দশকের বেশি সময়ের অবস্থানকালের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণও করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, বিভিন্ন কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উচ্চশিক্ষার প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অবিরত ধারায় এগিয়ে চলেছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের কারণে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বকীয়তা হারাতে বসেছিল।
কিন্তু যখন আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল তখনই অধিকার সচেতন শিক্ষার্থীরা গর্জে উঠে। তাদের সেই অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকেই আমরা স্বৈরাচার সরাতে পেরেছি। সেই সংগ্রামে আমরা হারিয়েছি এক হাজারেরও বেশি সাহসী সন্তানকে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে জাতি গঠনে নিবেদিত করা একান্ত প্রয়োজন। এজন্য অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রয়োজন গুণগত পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষকের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ সেই লক্ষ্যে সচেতনভাবে এগিয়ে যাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই। নতুন দেশ গঠনের প্রত্যয়ে আমাদের শিক্ষকদের অন্যতম মূল দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষাঙ্গণের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তা সত্ত্বেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী সংস্কার, কিন্তু রাতারাতি এটি সম্ভব নয়। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে ধৈর্যের সাথে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, এদেশের কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থী এবং একই বয়সের শ্রমজীবী মানুষরা দেখিয়েছে, কিভাবে দূরূহ, কঠিন ও অসম্ভবকে জয় করতে হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে মানহীনতা, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে বাংলাদেশকে এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জ হাতে নিতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কর্মোপযোগী ও উচ্চতর দক্ষতা অর্জনে সক্ষম ভালো মানের শিক্ষা ছাড়া এই রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে না। এই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলে আমাদের জাতি গঠনের মূল কাজই অসমাপ্ত থেকে যাবে।
এসময় উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বিগত ৭২ বছর কেমন কাটলো। পাশাপাশি আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর আগামীর জন্য পরিকল্পনা নিয়ে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই কালে আমাদের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা হবে বাধাহীন।
প্রসঙ্গক্রমে উপাচার্য বলেন, স্বৈরশাসন মানুষের স্বভাব নষ্ট করে দেয়। মানুষের আত্মপরিচয়কে ধ্বংস করে। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, তাই দীর্ঘকালের স্বৈরশাসন বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকেও কুলুষিত করেছে, এর আত্মসচেতনতাকে নাশ করেছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমাদের দেশ গঠনে কাজে লাগাতে হবে। আজ আমরা এক ক্রান্তিলগ্নে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে উদ্ভাবক ও আবিষ্কারক তৈরি করতে চাই।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকপত্রের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। স্মারকপত্রটিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুইজন প্রফেসর ইমেরিটাসসহ ১১ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্মৃতিচারণমূলক লেখা স্থান পেয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে অনুষদ অধিকর্তা, সিন্ডিকেট সদস্য, বিভাগীয় সভাপতি, ইনস্টিটিউট পরিচালক, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট শিক্ষকবৃন্দ, প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান, ছাত্র-উপদেষ্টা ড. মো. আমিরুল ইসলাম, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন মজুমদারসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
দিবসের কর্মসূচিতে আরও আছে, বিকেল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ও রশি টানাটানি খেলা।
আফরোজা