ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দুই অবস্থা

ক্লাস না করেই কেউ নিচ্ছেন বেতন কেউ যেতেই পারছেন না ক্লাসে

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:২৩, ৪ মে ২০২৫

ক্লাস না করেই কেউ নিচ্ছেন বেতন কেউ যেতেই পারছেন না ক্লাসে

ক্লাস না করেই কেউ নিচ্ছেন বেতন

গতবছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ১২০০ শিক্ষককে নানা কারণে পদত্যাগ করতে হয়। এরমধ্যে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ ফৌজদারি অপরাধও ছিল। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক হেনস্তা ও পদত্যাগে জোর করার ঘটনাও ঘটে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব শিক্ষকদের বেতন চালু রাখতে পরিপত্র জারি করে।

ফলে এই শিক্ষকদের প্রায় সবাই নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু নিয়মিত বেতন পেলেও তারা কেউ ক্লাসে যোগ দেননি। অধিকাংশ শিক্ষক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় স্কুলেও যাচ্ছেন না। এ অবস্থায় অন্তত ১২০০ শিক্ষক বেতন তুলছেন কিন্তু পাঠদানে ভূমিকা রাখছেন না। মাউশি সূত্র বলছে, বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কমিটি নেই। প্রতিটি স্কুলের অ্যাডহক কমিটি প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে। একটি উপজেলায় শতাধিক স্কুল-কলেজ। তারা যেমন নিয়মিত এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন না।

কিছুক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অ্যাডহক কমিটি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে শূন্যপদে নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগ দেওয়াও যাচ্ছে না। ফলে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এরমধ্যেই গত ২৭ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়মিত করার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। একইসঙ্গে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হবে তাদেরও একই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত চলতি বছরের ১৪ই জানুয়ারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক/সহকারী শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ, হেনস্তা ও বেতন ভাতা প্রসঙ্গে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে স্বাক্ষর করেন, উপ-সচিব সাইয়েদ এ. জেড, মোরশেদ আলী। পরিপত্রে বলা হয়, সম্প্রতি সকল জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ১৭ই ডিসেম্বর উল্লেখিত বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়ে জুম লিংকের মাধ্যমে একটি সভা করেছেন।

সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্তের সঙ্গে উল্লেখিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে আরও বলা হয়, জোরপূর্বক পদত্যাগের পেছনে যাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়ে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় যথাযথ নির্দেশনা জারি করবে। তদন্ত প্রতিবেদন আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বেতন-ভাতা চালু থাকবে। 
তবে এরপরও এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দুয়েকের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে একটি বৈঠক আছে।

বৈঠকে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কমিটির বিষয়ে তিনি জানান, এই সংকট আমরাও উপলব্ধি করছি। খুব শীঘ্রই সুরাহা করার আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু বৈঠকের পরও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বরং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। বিশেষ করে ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষককে জোরপূর্বক অবসর বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল, তারা সরকারের পরিপত্রের পরও বেতন পাননি। এমনকি ইচ্ছার পরও যোগদান করতে পারেননি।
রাজধানীর মনিপুর স্কুলের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বড় স্কুলে শিক্ষকদের একটি অংশ এমপিওর বাইরে। স্কুলের টাকায় তাদের বেতন হয়। মনিপুরের এমন ১৫ জন শিক্ষকের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা থাকার পরও বেতন দেওয়া হচ্ছে না ৪-৬ মাস। কোনো শিক্ষকই বেতন নিয়ে স্কুলে যাবে না এমন চিন্তায়ই করতে পারেন না। এদিকে ভিকারুননিসার দুই শিক্ষিকার বেতন দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। সরকারি নির্দেশনার পর তারা বেতন ও যোগদান করতে না পেরে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
তবে জেলা পর্যায়ের চিত্র আবার ভিন্ন। এসব জেলার অধিকাংশ শিক্ষক এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের এমপিও দেয় মাউশি ও মাউশির আঞ্চলিক অফিস। সরকারের এই পরিপত্র দেখিয়ে অফিস ম্যানেজ করে তারা সহজেই বেতন নিয়মিত করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মাউশি সূত্র বলছে, শুধু এসব শিক্ষকদের যোগদান বা বেতনই নয়, তাদের বেতন যেন ইএফটিতে হয় এর জন্যও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু এরপরও কেউ স্কুলে না যেয়েও বেতন পাচ্ছেন আবার কেউ পাঠদান করেও বেতন পাচ্ছেন না।
ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, রমজান মাস থেকেই নামের বানান ভুল, তথ্যগত ত্রুুটির কারণে হাজারও শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র ঢাকা জেলার সাড়ে তিন হাজার শিক্ষকের ফাইল অফিসে অনিষ্পত্তি হয়ে আছে বলেও জানান তিনি। এছাড়াও সরকারি পরিপত্রের পরও অনেক শিক্ষকের যোগদান না করতে পারার বিষয়টির সত্যতাও নিশ্চিত করেন।
কিন্তু অনুসন্ধানে ইফটির দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে যারা চাকরিচ্যুত বা সাময়িক বরখাস্ত তাদের অ্যাকাউন্টেও বেতন চলে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ফলে নতুন পদ্ধতির এই বেতন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক চাকরিচ্যুত শিক্ষক এভাবে বেতন পেয়ে মাউশিতে এসেছেন। এই বেতন কিভাবে ফেরত দেবেন তা জানতে চাইছেন।

বিষয়টি অনেক জটিল। আমরা ইএমআইএস সেলে কথা বলতে বলেছি। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই সেলের কর্মকর্তারা জানান, এমন শিক্ষক ক’জন আছেন। অনেকেই তো আছেন যারা বেতন পাচ্ছেন ও নির্বিঘেœ সরকারি অর্থ তুলছেন। যে টাকা তাদের পাওয়ার কোনো অধিকারই থাকে না।
গত মঙ্গলবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে মানিকগঞ্জ থেকে বেতন ফেরতের বিষয়ে জানতে এসেছেন এক শিক্ষক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার মোবাইলে বেতনের মেসেজ দেখে আমিও অবাক হয়েছি। আমার তো বেতন পাওয়ার কথা নয়। এজন্য মাউশিতে এসেছি। কি করা যায় এ বিষয়ে মতামত নিতে বিভিন্ন উইংয়ে ঘুরছি।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ইফটির শিটে সাময়িক বরখাস্ত বা চাকরিচ্যুত এমন কোনো কলাম ছিল না। যে কারণে এই ভুলগুলো অনেক বেশি হয়েছে। বিষয়গুলো দ্রুত সমাধান না হলে রাষ্ট্রের টাকা বেহাত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, এই ঘটনাটি আমি শুনিনি। তবে অভিযোগটি গুরুতর। আমি অবশ্যই তদন্ত করব ও ব্যবস্থা নেব।
নিয়োগ দেওয়ার সক্ষমতা নেই অ্যাডহক কমিটির ॥ সারাদেশে হাজারও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন নিয়মিত কমিটি নেই। অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু এই কমিটির কাজ শুধুমাত্র নিয়মিত কমিটির নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যার মেয়াদও ৬ মাস। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বিদ্যালয়ে এই সময়ে শত শত প্রধান শিক্ষক অবসরে গেছেন।

কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় এই কমিটি নিয়োগ দিতে পারছেন না। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। মাউশির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ, নিয়োগ নিয়মিত কমিটি ছাড়া হয় না। শুধুমাত্র অ্যাডহক কমিটির কারণে কর্মচারী ও সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে স্কুলগুলোর প্রশাসন ঝিমিয়ে পড়েছে। যা মাঠপর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের ভাবনা জানতে যোগাযোগ করা হয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব প্রফেসর ড. মোহা. জাগাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিয়মিত কমিটি জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু অ্যাডহক কমিটির বিষয়গুলো দেখেন বোর্ড চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে তিনিই উদ্যোগ নেবেন। এরপর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

আরো পড়ুন  

×