
ইউআইইউতে অচলাবস্থার নেপথ্যে শিক্ষক-প্রশাসকের
গেল কয়েকদিন ধরেই অস্থির ছিল দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নুরুল হুদাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে আওয়াজ তোলেন শিক্ষার্থীরা। যা পরবর্তীতে আন্দোলনে রূপ নেয়।
সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করেছে প্রশাসন। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে হাজারও শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এই ভার্সিটির অচলাবস্থার নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক-প্রশাসকদের দীর্ঘদিনের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ, শিক্ষকদের মধ্যকার দলাদলি অন্যতম। যার ফলে শিক্ষার্থীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ সব ঘটনাকেই মুহূর্তেই উস্কে দিয়েছে।
সবশেষ বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ঘটনায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করাটা বেশ অস্বস্তিকর। কারণ বিপুল শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। যা নিয়ে অনেকে ট্রাস্টি চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যদেরও দুষছেন। কারণ যখন প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে তাদের ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি না করে চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগও দুরুহ হয়ে যায়।
জানা যায়, মিডটার্ম পরীক্ষার পাঁচদিন আগে বাবাকে হারান ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইউ) ছাত্রী সুস্মিতা আফরিন। কয়েক বছর আগে একমাত্র ভাইকে হারানো এ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বাবার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ছিলেন। এতে নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা দিতে পারেননি। বাবার ডেথ সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে যান বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নুরুল হুদার কাছে। তাতে মন গলেনি বিভাগীয় প্রধানের।
নির্দেশনা দেন স্থানীয় কমিশনার অথবা ডিসির কাছ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট সত্যায়িত করে আনতে হবে। দুদিন অনেক চেষ্টা করেও তা জোগাড় করতে না পেরে সুস্মিতা আবারও ছুটে যান বিভাগীয় প্রধানের কাছে। সারাদিন বসে থেকেও শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। এতে রাগে-ক্ষোভে ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি, যা ভাইরাল হয়ে পড়ে। সুস্মিতা আফরিন বলেন, বাবাকে চিরবিদায় দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরলাম।
বাসা থেকে ফিরে ডিপার্টমেন্ট হেডের কাছে গেলাম। উনাকে ডেথ সার্টিফিকেট দেখালাম। মনে হলো উনি বিশ্বাসই করলেন না। আমার বাবার মারা গেছেন, মেডিক্যাল থেকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। অথচ সেটা কমিশনার বা ডিসিকে সত্যায়িত করানো লাগবে। এটা কেমন কথা! স্যারের এমন আচরণে আমি প্রচ-রকম ভেঙে পড়েছিলাম। শুধু সুস্মিতা নয়, একই দিনে (২২ এপ্রিল) আরও এক ছাত্রী তার খালার মৃত্যুর কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি জানিয়ে ইম্প্রুভমেন্ট দেওয়ার অনুমতি চান। তাকেও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে বেশ কয়েকদিন।
শিক্ষার্থীদের একের পর এক এমন অভিযোগে প্রশ্ন উঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইইউ কী এতই অমানবিক? বাবা-মা কিংবা স্বজনদের মৃত্যু, অসুস্থতা, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের কোনো ছাড় দেয় না কর্তৃপক্ষ! এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে অতি সম্প্রতি আরও একবার আন্দোলন করেছেন তারা।
তখন কর্তৃপক্ষ সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। অমানবিক আচরণ পরিহার করা হবে বলেও কথা দিয়েছিলেন তারা। অথচ কয়েকমাসের ব্যবধানে আবারও একই রকম স্বৈরাচারী আচরণ করছে কর্তৃপক্ষ। ফলে বাধ্য হয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছেন।
যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউআইইউ বছরে শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৬ কোটি টাকার স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব এবং শিক্ষা-গবেষণাকে উৎসাহিত করে। সেখানে দু-একজনের আচরণ বা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা দিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করা উচিত নয়। অন্যদিকে শিক্ষকদের ওপরও শিক্ষার্থী কর্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে শিক্ষকরাও আর পড়াতে চাননি। যে কারণে প্রশাসন বাধ্য হয়েই বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে।
যদিও সুস্মিতা আফরিন নামের ওই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন সিএসই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নুরুল হুদা। নিজের একটি বিবৃতিও তিনি দিয়েছেন। জানতে চাইলে অধ্যাপক নুরুল হুদা মঙ্গলবার বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে একটা ঝামেলা রয়েছে। এটা ২০২৩ সাল থেকে আমাদের পেন্ডিং (ঝুলে থাকা)। সেটা নিয়ে কাজ চলছিল।
এ কারণে ওই দু-তিনদিন আমি চরম ব্যস্ত ছিলাম। শিক্ষার্থীদের কল্যাণেই এ কাজটি করা হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা আমার সঙ্গে কথা বলতে এলে আমি ১০-১৫ মিনিট সময় দেই তাদের। কিন্তু সেদিন সময়টা বের করতে পারিনি। সবমিলিয়ে যা হয়েছে, তার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আমার ভুল স্বীকার করে নিচ্ছি।
ডেথ সার্টিফিকেট আনার পরও সত্যায়িত কেন লাগবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছ থেকে সার্টিফিকেট বা প্রত্যয়নটা এলে ভালো হয়। তারপরও আমার উচিত হয়নি এটা করা। ব্যস্ততা না থাকলে হয়তো কথা বলে তখনই এটা সমাধান হয়ে যেত। সেদিন যে ছাত্রী এসেছিল, তার সঙ্গে আরও একজন এসেছিল; যার কি না খালা মারা গেছেন। সে তো ডেথ সার্টিফিকেট এনে গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) অনুমোদন নিয়ে গেছে। যার খালা মারা গেল; তাকে আমরা দিলাম আর বাবা হারানো ছাত্রীকে দেব না, তা তো না। অবশ্যই তাকে ফ্রি পরীক্ষাটা দিতে দেওয়া হতো এবং হবে।
বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ^বিদ্যালয়টির বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ড উদাসীন। ছাত্রদের দাবি আদায়ে যখন প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে তখন তাদের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও হয়নি। উল্টো এই আন্দোলনে অনেক শিক্ষকের ইন্ধন ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। জনকণ্ঠের হাতে আসা একটি হোয়াটসঅ্যাপ স্ক্রিনশটে দেখা যায়, সালেকুল নামের একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মেসেজে বলছেন তোমরা সাবধান থেক, হুদা ভাইকে প্রটেক্ট বা সেভ করার দরকার নেই।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কেন বন্ধ করা হলো এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, আন্দোলনের এক পর্যায়ে শিক্ষকদের ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। যে কারণে কোনো শিক্ষকই আর ক্লাসে যোগ দিতে চাননি। পরে প্রশাসন বাধ্য হয়েই সব কার্যক্রম বন্ধ করে। তবে যারা শিক্ষকদের ধাক্কা দিয়েছেন তারা বহিরাগত বলেও জানানো হয়।
পুরো ঘটনা বুঝে ওঠার আগেই শিক্ষার্থীরা বড় মুভমেন্টে চলে গেছে বলে মনে করেন সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম মিয়া। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ওই ছাত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। শুক্রবার ছুটির দিন। শনিবার আমি অফিসে এলাম। দুপুরে শুনি আমার পদত্যাগ দাবিতে তারা অনশন করছেন। আমি জানতে চাইলাম কেন আমাকে পদত্যাগ করতে হবে? তারা বললেন, শিক্ষার্থীদের দেওয়া আলটিমেটামকে নাকি আমি পাত্তা দেয়নি।
অথচ আমি জানিই না যে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম আলটিমেটাম কবে কার কাছে দিয়েছ? ছাত্ররা জানালেন তারা ফেসবুকে আলটিমেটাম দিয়েছেন। তাহলে আমি তো ফেসবুকের আলটিমেটাম দেখিনি ব্যবহার করি না ফেসবুক।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা উচিত হয়নি। ইউআইইউ এ ধরনের আচরণ সমর্থন করে না। কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট দিলেই তো আমরা সঙ্গে সঙ্গে একজন বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। আমারও তো আইন মানতে হবে। ঘটনা তদন্ত করে প্রাথমিক সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিংবা অভিযোগ পেলেও সাময়িকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সেই সুযোগটাও তো পেলাম না। তার আগেই পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো।