
বিশ্বজুড়ে বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও, এর ভয়াবহতা অনেক সময় দৃষ্টিসীমার বাইরেই থেকে যায়। শুধু প্রাণহানিই নয়, বজ্রপাত মানুষের চোখের ওপরও ফেলতে পারে মারাত্মক প্রভাব। আধুনিক বিজ্ঞান যেমন বিষয়টি ব্যাখ্যা করছে, তেমনি দেড় হাজার বছর আগেই কোরআনেও এই বিষয়ে রয়েছে ইঙ্গিত।
প্রতি এক সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বার বজ্রপাত হয় এই পৃথিবীতে। প্রতিবছর প্রায় ২৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বজ্রপাতের কারণে। এর বাইরে এটি মানুষের দৃষ্টিশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, বজ্রপাতের আলো এতটাই তীব্র যে এটি চোখের রেটিনাকে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা এই অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘ফ্ল্যাশ ব্লাইন্ডনেস’ বা তাৎক্ষণিক অন্ধত্ব। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, বজ্রপাতের একেকটি ঝলক ১০ কোটি ভোল্টের বেশি বৈদ্যুতিক শক্তি তৈরি করে। বজ্রপাতের সময় তাৎক্ষণিকভাবে যে আলো বের হয়, সেটি সূর্যের থেকেও প্রায় পাঁচ গুণ বেশি উজ্জ্বল হতে পারে। আপনার চোখ যদি সরাসরি এই আলো গ্রহণ করে, তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু এই তথ্য কি শুধুই আধুনিক আবিষ্কার? না। অবাক করার মত বিষয় হলো, ১৪০০ বছর আগে কোরআনে এই বিষয়ের ইঙ্গিত খুব স্পষ্টভাবেই দেওয়া হয়েছে।
মহান আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ২০ নম্বর আয়াতে বলেন, “বজ্রপাত তাদের দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। যখনই বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, তারা তার আলোতে চলতে থাকে। আর যখন অন্ধকার নেমে আসে, তারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নিতে পারেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান।”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাসীরে লেখা হয়েছে, মুনাফিক দুই প্রকার। খাঁটি মুনাফিক ও সন্দেহের দোলায় দোদল্যমান মুনাফিক। সূরা বাকারার এই আয়াতে বিদ্যুৎ ও বজ্রপাতের উপমা দিয়ে মূলত এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মুনাফিকদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ তারা কখনো ঈমানের আলোকে আলোকিত হয়, আবার কখনো কখনো কুফরীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। প্রথম প্রকারের মুনাফিক থেকে তাদের মুনাফিকির অবস্থা কিছুটা নরম।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোরআনের এই বর্ণনা কি শুধুই উপমা দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে? নাকি এর পেছনে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে?
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ফ্ল্যাশ ব্লাইন্ডনেস হচ্ছে সাময়িক বা স্থায়ী অন্ধত্ব, যা তীব্র আলো চোখে পড়ার ফলে ঘটে। যেমন নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ, ফ্ল্যাশ ফটোগ্রাফি, বজ্রপাত ইত্যাদি। আধুনিক বিজ্ঞানীরাও বলছেন, ফ্ল্যাশ ব্লাইন্ডনেস হয় ঠিক তখন, যখন কোনো তীব্র আলো চোখের রেটিনাকে অস্থায়ীভাবে দুর্বল করে দেয়। এই আলো যদি খুব শক্তিশালী হয়, অন্ধত্ব স্থায়ীও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতের সময় নির্গত আলো প্রায় ১,০০০ মিলিয়ন থেকে ১ লাখ মিলিয়ন ক্যান্ডেলা পর্যন্ত উজ্জ্বলতা তৈরি করে। এই তীব্রতা আমাদের চোখের স্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে। ফলে যারা বজ্রপাতের কাছাকাছি থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ ব্লাইন্ডনেস বা তাৎক্ষণিক অন্ধত্বের ঝুঁকি বেশি থাকে।
কখনো কখনো এই অন্ধত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে বজ্রপাতের তাপমাত্রা। সাধারণত বজ্রপাতের ঝলক তৈরি করে এমন তাপমাত্রা ৩ হাজার কেলভিন পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা সূর্যের পৃষ্ঠের থেকেও অনেক গুণ বেশি। এই তাপমাত্রা চোখের রেটিনায় ফটোকেমিক্যাল বার্ন তৈরি করে, যা অন্ধত্বের স্থায়ী কারণ হতে পারে।
এছাড়াও বজ্রপাতের সময় এক ধরনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস বা ইএমপি সৃষ্টি হয়। এই ইএমপি মস্তিষ্ক ও চোখের স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে, দৃষ্টিশক্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদনে। ২০০৩ সালে জার্নাল অফ নিউরোলজি-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বজ্রপাতে আক্রান্ত কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী চোখের ক্ষতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বজ্রপাতের শিকার রোগীর চোখের রেটিনাল বার্ন ধরা পড়ে, যা তাকে স্থায়ীভাবে দৃষ্টিহীন করে দেয়। এছাড়াও ২০১২ সালে জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইন্স-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, বজ্রপাতে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগীর চাক্ষুষ সমস্যা তৈরি হয়, যার মধ্যে রেটিনাল ডিটাচমেন্ট এবং অপটিক নার্ভ ড্যামেজ ছিল উল্লেখযোগ্য।
কোরআনের আয়াতটিতে বলা হচ্ছে, বজ্রপাত তাদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারে। বিজ্ঞানও বলছে, বজ্রপাতের তীব্র আলো ও তাপ আমাদের রেটিনাকে আঘাত করতে পারে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই অস্থায়ী অন্ধত্ব স্থায়ীও করতে পারেন। গবেষণাতেও আমরা সেই বাস্তবতায় দেখতে পাচ্ছি। অতএব, আয়াতে বর্ণিত তথ্যটি কেবল রূপক নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতাও।
দেড় হাজার বছর আগে যখন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, গবেষণা বা আধুনিক মেডিকেল সাইন্সের কোন অস্তিত্বই ছিল না, তখন কোরআনে বজ্রপাতের এমন নিখুঁত বর্ণনা এক কথায় বিস্ময়কর। আজকের বিজ্ঞান সেই সত্যকেই নতুন করে প্রমাণ করেছে। তাই আসুন, কোরআনের এই জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে আমরা আরো চিন্তাভাবনা করি।
সূত্র:https://tinyurl.com/2c2fpf7v
আফরোজা