ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ মে ২০২৪, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

স্বপ্ন দেখি বিশ্বকে মানবতার রঙে সাজানোর

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

স্বপ্ন দেখি বিশ্বকে মানবতার রঙে সাজানোর

দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাওয়া তরুণদের ৩০ সংগঠনের হাতে গত ১৭ নবেম্বর তুলে দেয়া হয় জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড। ইয়াং বাংলা আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। বিজয়ীদের মধ্যে একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^দ্যিালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আয়েশা আক্তার ইতি। ছোটবেলা থেকে গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন। ৪ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ইতি। পুরো লকডাউনজুড়ে করে গিয়েছেন নানা সমাজ-সেবামূলক কাজ। নিজের হাতে গড়া সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি’-এর ব্যানারে অসহায় দরিদ্র মানুষদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্যসামগ্রী ও অর্থসহায়তা। কাজ শুরুর পর থেকেই ইতির বাবা নিজে ইতির সঙ্গে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কাজ করেছিলেন। গ্রামের বাজারে গেলে তার বাবাকে এলাকার মানুষ বলত, ‘কি দরকার ভাই, মেয়ে বড় হয়েছে, বাড়িতে থাকবে। মেয়েকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরেন, লিস্ট বানান, এসব কি তরুণী মেয়ের সঙ্গে যায়? ওর কাছে যা টাকা পয়সা আছে, আমাদের পুরুষ মানুষদের দেন, আমরা ভাগ করে চাল-ডাল দিয়ে দেব সবাইকে।’ কিন্তু ইতির বাবা বলত, ‘ভাই, এই এলাকায় ছেলেরা যা করে না, মানুষ যা দেখেও দেখে না, তা আমার মেয়ে করে। আমি প্রতিদিন ওরে নিয়ে লিস্ট করতে যাই, আমার কাছে আনন্দের লাগে। আমার মেয়ে আমার গর্বের। ও কাজ করবে, করুক। সমাজ যা বলার, বলুক। আমার কিছু আসে যায় না। আমার মেয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক, এটাই চাই।’ করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রথমদিকে খুব বেশি ভলান্টিয়ার পাওয়া যায়নি। ১৪ জেলায় ২৫ জন ভলান্টিয়ার নিয়ে কাজ শুরু করেন ইতি। জরুরী খাদ্য ও অর্থ সহায়তা নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যান তিনি নিজে ও তার ভলান্টিয়াররা। লকডাউনে প্রথম যখন নোয়াখালী জেলায় ২০০ পরিবারের কাছে জরুরী সহায়তা পৌঁছে দেয় তারা, তখন সারাদিন-রাত ধরে ইতি ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তখন ইতির বাবা, ইতি ও ভলান্টিয়ারদের সঙ্গেই খাদ্যসামগ্রী নিজ কাঁধে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে। পরিবারের এমন সমর্থন ও ভালবাসা তাকে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম করেছে বলে মনে করেন অদম্য সাহসী এই মেয়ে। তার এই অদম্য সাহস ও সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার প্রবল আগ্রহের প্রেরণাস্বরূপ গত ১৭ নবেম্বর ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড-২০২০’ পান তিনি। এ বছর ৭০০ এর অধিক সংগঠন হতে এ্যাওয়ার্ডটি সর্বোমোট ৩০টি সংগঠনের ৩০ জনকে দেয়া হয়েছে। ২টি ক্যাটাগরিতে ও ১৩টি সাব ক্যাটাগরিতে এই বছর এ্যাওয়ার্ডটি প্রদান করা হয়। করোনাকালীন সময়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করায় ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি’ এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এ্যাওয়ার্ডটি পান আয়েশা আক্তার ইতি। লকডাউনের সময় মানুষের জন্য জরুরী খাদ্য ও অর্থ সহায়তা, রমজান ফুড প্যাক, ঈদ উপহার ও পাবলিক এ্যাওয়ার্নেস ক্যাম্পেইন করার জন্য মূলত এই এ্যাওয়ার্ডটি অর্জন করেন ইতি ও তার ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি’। ‘ণড়ঁৎ ংরসঢ়ষব বভভড়ৎঃং নৎরহম যধঢ়ঢ়রহবংং’ এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে ২০২০ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি’। পুরস্কার পেয়ে উচ্ছ্বসিত ইতি বলেন, ‘সত্যি বলতে আমরা এ্যাওয়ার্ডের জন্য কাজ করিনি। আমরা সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছি। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যুব এ্যাওয়ার্ড ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড ২০২০’ এর বিজয়ী হতে পেরে আমি এবং আমাদের ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি পরিবার অত্যন্ত আনন্দিত। এই অর্জন আমাদের সবার। নিঃসন্দেহে এই অর্জন আমাদের ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ আর্মি পরিবারকে আরও উৎসাহিত করবে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের গল্পটা সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যাক। সবাই জানুক, তরুণরা চাইলে সব সম্ভব।’ ইতি মনে করেন মানুষের জন্য কাজ করাটা তরুণদের জন্য হওয়া উচিত দায়িত্বস্বরূপ। একজন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়ে মানুষের কষ্ট দেখে লকডাউনের আতঙ্কের ভেতরেও ঘরে বসে থাকতে পারেননি তিনি, ছুটে গিয়েছেন মানুষের জন্য কাজ করতে। সংগঠন শুরু করাটা সহজ ছিল না তার জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত শিক্ষক, ভাই-আপু, বন্ধু ও কাছের মানুষের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এগিয়ে যান ইতি। একজন মেয়ে হওয়ায় প্রতি পদক্ষেপে সমাজের মানুষের কটু কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তার যে মানুষের জন্য কাজ করার প্রচণ্ড ইচ্ছা জন্মেছিল। মানুষের জন্য ভালবাসা এই সাহসী মেয়েটিকে এনে দিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যুব সম্মাননা। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার নোয়াখলা গ্রামে বেড়ে উঠেছেন আয়েশা আক্তার ইতি। সামাজিক স্বেচ্ছসেবামূলক কাজের পাশাপাশি নিজের পড়াশোনায়ও বরাবরই মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বকে মানবতার রঙে সাজানোর, যে রঙের আলোকচ্ছটায় সমাজ থেকে বিদায় নেবে বৈষম্য ও দারিদ্র্য।
×