ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৭ আগস্ট ২০২৫, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২

বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড ও স্বাস্থ্য বিমা থাকতে হবে 

কর্মক্ষম জাতি গঠনে বাজেটের ১২ শতাংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে দিতে হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ৭ আগস্ট ২০২৫

কর্মক্ষম জাতি গঠনে বাজেটের ১২ শতাংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে দিতে হবে

ছবি: সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সুস্থ জনগোষ্ঠী একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষম জনশক্তিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। সুস্থ জাতি সব সময় কর্মক্ষম এবং উন্নত জাতি। তবে শারীরিক এবং মানসিক সুস্থ জাতি তৈরি করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সাবর্জনীন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সবার জন্য হেলথ কার্ড চালু ও ন্যাশনাল হেলথ ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন।


শুধুমাত্র বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা (কো-অর্ডিনেটেড ইফোর্ট অ্যান্ড প্ল্যান)। বর্তমানে বাজেটের অধিকাংশ সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, অপচয় এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে। বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোপুরি ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ, বাস্তবায়নের হার এবং এ খাতের সেবার মান বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও আসন্ন এফবিসিসিআই নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম।

ডা. এজেডএম জাহিদ জনকণ্ঠ বলেন, আমরা বিগত ১৫-১৬ ধরে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কখনোই তা আমলে নেওয়া হয়নি। উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সুস্থ-সবল মানুষ বেশি প্রয়োজন। কিন্তু দেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা অপ্রতুল, ফলে মানুষকে নিজ অর্থে চিকিৎসা নিতে হয়। জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করাতে অনেকে শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত খরচ করে ফেলেন। জায়গা-জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে হয়। অথচ সরকারিভাবে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো গেলে চিকিৎসা সহজলভ্য করা যেত। একটি কর্মঠ জাতি গঠনে সকলের সুস্থতা প্রয়োজন। দেশ এখন নির্বাচনমুখী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা হবে ইনশাআল্লাহ।


স্বাস্থ্যখাতের ওপর গুরুত্বারোপ করে সাকিফ শামীম বলেন, সুস্থ জাতিই কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত এগিয়ে নিতে পারেন। এজন্য জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন। চলতি বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বা ০ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। এ দুই মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পেয়েছে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, যা অন্যান্য খাতের মধ্যে সপ্তম এবং এটা স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের চেয়ে অনেক কম। বাজেট ঘোষণার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। কমিশন স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বা জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করেছিল। বিশ্বের ৫১টি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে বাজেটের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম। ভুটান তাদের মোট জাতীয় বাজেটের ৮ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেয়। শুধু তাই  নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর  স্বাস্থ্য বরাদ্দের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একদম তলানিতে রয়েছে।

সাকিফ শামীম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। মন্ত্রণালয় যেন বরাদ্দকৃত বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারে, সেদিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারের উচিত তহবিল ব্যবহার করতে না পারার কারণ চিহ্নিত করা এবং বরাদ্দের ১০০ শতাংশ ব্যয় নিশ্চিত করার জন্য প্রথমদিন থেকেই সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো।

তিনি বলেন, সুদীর্ঘ সময়ে এ খাতে আধুনিক কোনো ফ্যাসিলিটিজ গড়ে তোলা হয়নি এবং এরজন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের একটি দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক। এছাড়াও, স্বাস্থ্যখাতে উন্নতির প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা এবং এর সমাধানে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। হেলথ কার্ড প্রদানে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে এবং ন্যাশনাল হেলথ ফান্ড গঠন করা এ মুহূর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, যাতে করে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা যায়। শুধুমাত্র বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব না। তিনি জানান, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো এখাতে সঠিক পরিকল্পনার অভাব, অগ্রাধিকার চিহ্নিতকরণ, দুর্নীতি এবং অপচয়।

এছাড়াও, মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের অদক্ষতাও একটি কারণ। সাকিফ শামীম বলেন, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আলোকে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এটি ছাড়া নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘোষণা অনুযায়ী,  ২০৩০ সালের মধ্যে সকল নাগরিককে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে সেবার পরিধি বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল নিয়োগে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, সব ধরনের চিকিৎসায় ব্যক্তিপর্যায়ে খরচ কমিয়ে আনা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ, অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবায় প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যের সামাজিক সূচকগুলোকে চিহ্নিতকরণ, স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা সার্ভিস গঠন, ম্যানেজারিয়াল দক্ষতা বৃদ্ধি, ক্রয়নীতি সংস্কার, জনবলের ঘাটতি পূরণ, সমন্বয় বৃদ্ধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অডিট পদ্ধতি সংস্কার, স্বাস্থ্য বৈষম্য দূরীকরণের মতো কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

ব্যবসায়ী নেতা সাকিফ শামীম স্বাস্থ্যখাত ও বিমায় গুরুত্বারোপ করে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হলে দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য কার্ড ও স্বাস্থ্য বিমা থাকতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য কার্ড হলো একটি ডিজিটাল কার্ড, যা একজন ব্যক্তির চিকিৎসা সংক্রান্ত সব তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেজে সংরক্ষণ করে। এটি একটি অনন্য হেলথ আইডি নম্বরের মাধ্যমে কাজ করে, যার সাহায্যে একজন রোগীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল স্বাস্থ্যসেবার বিস্তারিত তথ্য যেমন-চিকিৎসার ইতিহাস, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন ইত্যাদি একটি প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য কার্ডের মাধ্যমে একজন চিকিৎসক রোগীর পূর্ববর্তী সব তথ্য সহজেই পেতে পারেন, যা সঠিক রোগ নির্ণয় ও উন্নত চিকিৎসা প্রদানে সহায়তা করে। এর ফলে ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি কমে আসে। এছাড়া চিকিৎসক, নার্স এ খাতের সেবা প্রদানকারীদের অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে অনৈতিক চর্চা বিমা বা Malpractice Insurance থাকতে হবে। এটি এক ধরনের পেশাগত দায় বিমা (Professional Liability Insurance), যা চিকিৎসাসেবা প্রদানকারীদের (যেমন : চিকিৎসক, সার্জন, নার্স) চিকিৎসার ভুল, অবহেলা বা অন্য কোনো অনৈতিক চর্চার কারণে রোগীর কোনো ক্ষতি হলে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করে।

অন্যদিকে, চিকিৎসা মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ চিকিৎসার খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটায়, যা প্রায় ৭০%। হঠাৎ করে বড় কোনো রোগ বা দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলে বা ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। স্বাস্থ্য বিমা থাকলে এই ধরনের আর্থিক চাপ থেকে পরিবার সুরক্ষিত থাকে। এছাড়া প্রাইভেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মডেল ফার্মেসি গড়ে তোলা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবা, টেলিমেডিসিন, ই-স্বাস্থ্য সেবা ও অনলাইন ফার্মেসি গড়ে তুলতে হবে। ওষুধ শিল্পে অচও (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট) খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংক্ষেপে বলা যায়, অচও হলো ওষুধ শিল্পের মেরুদণ্ড। একটি নিরাপদ, কার্যকরী এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ তৈরি করার জন্য উন্নতমানের অচও উৎপাদন ও ব্যবহার অপরিহার্য। দেশে দ্রুত এপিআই শিল্পপার্ক পুরোদমে চালু ও কার্যকর করতে হবে।

 

শিহাব

×