
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর
নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলেই প্রধান নীতি সুদহার কমানো হবে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন আগামী ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২ এবং জুনে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ গত জুনে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সংবাদ সম্মেলনে চার ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও অন্য কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ধীওে ধীরে কমছে। তবে এখন আমাদের কাক্সিক্ষত মাত্রায় আসেনি। আমাদের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। মূল্যস্ফীতি কমে গত জুনে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা এবং উৎপাদন ভালো হওয়ায় এটা কমছে। চাল ছাড়া সব পণ্যের দর স্থিতিশিল রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খারাপ না। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে- প্রবৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশিলতা একটা বড় বিষয়।
এক প্রশ্নের তিনি বলেন, আমানতকারীদের আতঙ্কের কিছু নেই। তাদের সঞ্চয় সম্পূর্ণ নিরাপদ। এবার বড় আকারে সার্জারি করা হবে। সরকার বড় অঙ্কের তহবিল জোগান দেবে। মুনাফাসহ সেই টাকা ফেরত নিতে পারবে সরকার।’
নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত প্রধান নীতি সুদহার (রেপো) ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে। মূলত ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে রেপোর বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়। অন্যদিকে, নতুন মুদ্রানীতিতে আন্তঃব্যাংক ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি সুদহার স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকছে। আর স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৮ শতাংশই থাকছে।
ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে টাকা রাখার ক্ষেত্রে এ সুদহার প্রযোজ্য হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে আগামী বছরের জুন নাগাদ গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা সামান্য বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ ধরা হয়েছে। গত জুন পর্যন্ত মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিল। তবে অর্জিত হয়েছে ৭ শতাংশ। সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। গত অর্থবছর ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ ঋণপ্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।
মুদ্রানীতি ঘোষণার শুরুতে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২০২৪ সালের আগস্টে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় সামষ্টিকভাবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ছিল ক্রমাগত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বহিরাগত পরিশোধের বকেয়া জমা, কঠোর তারল্য পরিস্থিতি, সুশাসনের অভাব এবং উন্নত খেলাপি ঋণ।
‘এর প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট এবং ভবিষ্যৎমুখী কৌশল রূপরেখা দিয়েছে, যেখানে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্নির্মাণ এবং উন্নত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনরুদ্ধারের দৃঢ প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য, বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কঠোর মুদ্রানীতির অবস্থান বজায় রেখেছে। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ নমনীয় বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতকে লক্ষ্য করে বিস্তৃত সংস্কার কর্মসূচিও শুরু করে। যে কারণে সমন্বিত চাহিদা এবং সরবরাহ-পার্শ্বিক ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় শিরোনাম মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে।’
‘ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা এবং সুশাসন ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে, আমানতকারীদের আস্থা উন্নত হয়েছে এবং তারল্য পরিস্থিতি ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণের ফলে এই ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক মুদ্রানীতি বিবৃতির (এমপিএস) এই সংখ্যাটি বিকশিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় ক্ষেত্রেই দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে পরিলক্ষিত প্রকৃত ফলাফল, অর্থ ও ঋণের পূর্বাভাস এবং অংশীদারদের সঙ্গে ব্যাপক পরামর্শের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে যে মুদ্রানীতি গ্রহণ করবে তা বর্ণনা করে।
ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উত্তেজনা এবং বর্ধিত নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মার্কিন প্রশাসনের সাম্প্রতিক শুল্ক বৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা রপ্তানির ঝুঁকি তৈরি করে, বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটায় এবং আর্থিক বাজারের অস্থিরতা তীব্র করে তোলে। তাছাড়া, চাহিদা হ্রাস, মুদ্রার অস্থিরতা এবং হাইড্রোকার্বনের দাম হ্রাসের কারণে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অতএব, দুর্বল প্রবৃদ্ধি এবং নি¤œ মুদ্রাস্ফীতির দ্বৈত প্রেক্ষাপটের কারণে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে বা বর্তমান নি¤œস্তরে স্থিতিশীল রাখতে আরও বেশি আগ্রহী হতে পারে। এদিকে, ২০২৫ এবং ২০২৬ সালে বিশ্ব পণ্যের দাম হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা এবং দেশীয় বাজারে তারল্য পরিস্থিতি ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করবে।
বর্তমান উন্নয়ন এবং পূর্বাভাস ধারাবাহিকভাবে মুদ্রাস্ফীতির হ্রাস এবং বাস্তবে নীতিগত হার ৩.০ শতাংশে পৌঁছানোর পরে, বিবি ধীরে ধীরে নীতিগত হার কমাতে শুরু করবে। তদুপরি, যদি শুল্কের ধাক্কা এবং দুর্বল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার কারণে রপ্তানি দুর্বল হয়ে পড়ে, অবচয় চাপের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী ব্যয় কমাতে এবং মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যগুলো নিরাপদে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনে নীতিগত হার সামঞ্জস্য করবে।’
প্যানেল হু