ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রেকর্ড: বার্ষিক পরিশোধ ছাড়াল ৪ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৮ জুলাই ২০২৫

বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে রেকর্ড: বার্ষিক পরিশোধ ছাড়াল ৪ বিলিয়ন ডলার

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বার্ষিক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ২৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে মোট ৪.০৮৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বার্ষিক পরিশোধ। আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধে ২১.২ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। এর মধ্যে মূল অর্থ পরিশোধে ২.৫৯৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮.৮ শতাংশ বেশি। সুদ পরিশোধ হয়েছে ১.৪৯১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০.৫ শতাংশ বেশি।

 

 

ইআরডি জানিয়েছে, গত এক দশকে নেওয়া অবকাঠামো প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার বড় বড় ঋণগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় পরিশোধের চাপ বেড়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আরও কিছু ঋণের গ্রেস পিরিয়ড আগামী এক-দুই বছরের মধ্যেই শেষ হতে যাচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতে এই চাপ আরও বাড়বে। অর্থনীতিবিদরাও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে সরকার একাধিক বড় প্রকল্প হাতে নেয় যেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয়, অপরিকল্পিত এবং সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছিল। এসব প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছিল এবং প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোর অর্থনৈতিক অবদান সীমিত ছিল। রাজস্ব আহরণ দুর্বল হওয়ায় সরকার বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলে মাত্র সাত বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক ঋণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছিল কঠিন শর্তযুক্ত, যেগুলোতে সুদের হার বেশি, গ্রেস পিরিয়ড কম এবং দ্রুত পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ছিল। কোভিড-১৯ মহামারির পর এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে একাধিক বাজেট সহায়তা ঋণ নিতে হয়েছে, যেগুলোর পরিশোধের সময় এখন এসে গেছে। এর ফলে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বাজেট খরচের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে চাপে পড়েছে। এখন প্রয়োজন একটি নতুন রাজস্ব ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল, যেখানে ঋণ গ্রহণের সামর্থ্য এবং পরিশোধের সক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে।

 

 

 

অন্যদিকে, ঋণ পরিশোধ বেড়ে গেলেও নতুন ঋণ চুক্তি এবং ঋণ বিতরণ উভয়ই কমে গেছে ২৫ অর্থবছরে। ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বাংলাদেশ উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে মোট ৮.৩২৩ বিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণচুক্তি করেছে, যা আগের বছরের ১০.৭৩৯ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে কম। একইভাবে, ঋণ বিতরণও কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৬৮ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছর ছিল ১০.২৮৩ বিলিয়ন ডলার। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক স্থবিরতার কারণে বিদেশি ঋণপ্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি ঠিকাদাররা প্রকল্প থেকে সরে গেছে, ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া, মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ গ্রহণ হ্রাস করেছে। তবে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় রেকর্ড ৩.৪ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়া গেছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, যার পরিমাণ ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), যার প্রতিশ্রুতি ২ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন বাজেট সহায়তা। জাপান দিয়েছে ১.৮৯ বিলিয়ন ডলার এবং এআইআইবি দিয়েছে ৫৬১ মিলিয়ন ডলার। ঋণ বিতরণে এডিবি প্রথম, যাদের বিতরণ ২.৫২ বিলিয়ন ডলার, এরপর বিশ্ব ব্যাংক ২.০১২ বিলিয়ন, জাপান ১.৫৮ বিলিয়ন, রাশিয়া ৬৭৫ মিলিয়ন, এআইআইবি ৫২৭ মিলিয়ন, চীন ৪১৫ মিলিয়ন এবং ভারত দিয়েছে ১৮৫ মিলিয়ন ডলার।

 

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ এখন ঋণ পরিশোধের এক কঠিন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগত সময়ের ঋণ পরিশোধ আরও বাড়বে বলে  আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই এখনই দরকার যথাযথ আর্থিক কৌশল গ্রহণ, যাতে করে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়।

ছামিয়া

×