
.
দু’দেশের স্বার্থেই বাংলাদেশ-ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য চলমান রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এদিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরই বুড়িমারী ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আটকে আছে অর্ধশতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। এসব ট্রাক ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে রপ্তানিকৃত এসব পণ্যের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সব সময় ভারতের অনুকূলে রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্যসামগ্রী আমদানি করে সেই তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম। শুধু বৈধ পথেই দু’দেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের পণ্য।
বাণিজ্য ঘাটতি সব সময় ভারতের অনুকূলে রয়েছে। এ অবস্থায় স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে ভারত পণ্য আমদানির নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বাংলাদেশ-ভারতের ব্যবসা চলমান থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। রবিবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে ভারতের বিধিনিষেধের বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে বাংলাদেশের কী করণীয়, তা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ভারতে আমাদের আসবাব খুব বেশি রপ্তানি হয় না, সেই তুলনায় পোশাকের বড় রপ্তানি হয়। আমাদের দেশ থেকে যে রপ্তানি হয়, তার মূল কারণ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। আমরা আশা করছি, উভয় দেশের ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থে এটা চলমান থাকবে। তবে দেশটির এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভৌগোলিক কারণে আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পরিস্থিতি বুঝতে দু-এক দিন লাগবে, এরপর করণীয় ঠিক করা হবে। শেখ বশিরউদ্দীন আরও বলেন, আমরা বাণিজ্য উদারীকরণে বিশ্বাসী। ব্যবসায় অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে কাজ করতে হবে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করা আমাদের কাজ। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ব্যবসা, তাতে ভারতের পাল্লাই ভারি। একদিনে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না। এটা দূর করতে বেশ সময় লাগবে। এদিকে, স্থলপথে ভারত আমদানি বন্ধ করায় দেশের রপ্তানি বাণিজ্য চাপের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, পাল্টা পদক্ষেপ না নিয়ে বরং কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকার যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য ভালো খবর নয়। দুই দেশের মানুষের জন্যও এটা ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে। ভারতের এই বিধিনিষেধের ফলে এখন আমাদের বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, এখন অনেক পথ ঘুরে ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। আগে সহজে বিভিন্ন স্থলবন্দর ব্যবহার করে দেশটিতে পণ্য পাঠানো যেত। কয়েক বছর ধরে ভারতে আমাদের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা সাফটার আওতায় দেশটিতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল। এখন সেখানে ভাটা পড়তে পারে। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে আমরা পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের মাধ্যমে এগোচ্ছি। প্রথমে তারা ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল। পরে আমরা স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও সুতা আমদানি নিয়ে বস্ত্রকল ও পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে দুইরকম বক্তব্য রয়েছে। স্থানীয় শিল্প হয়তো এতে লাভবান হবে। তারপরও যে কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সব দিক ভালোভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। নতুন করে ভারত যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিপরীতে আমাদের পাল্টা পদেক্ষপ নেওয়া ঠিক হবে না। বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, নিশ্চিতভাবেই স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশের জন্য ভারত একটি ক্রমবর্ধমান রপ্তানি গন্তব্য। নতুন নিষেধাজ্ঞা প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে রপ্তানি বাড়ানোর প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করবে। যেহেতু তাদের কলকাতা দিয়ে রপ্তানি করতে হয়, তাই সময় ও খরচ বাড়বে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারানোর কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং এ নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পাঠানো বন্ধের জন্য ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. জাহিদ বলেন, ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশ সমুদ্র ও স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো ভারত।
নিষেধাজ্ঞার পরই স্থলপথে আটকে আছে পণ্যবাহী ট্রাক ॥ স্থলপথে ভারত পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরই অর্ধ শতাধিকের বেশি পণ্যবাহী ট্রাক বিভিন্ন বন্দরে আটকা পড়েছে। বুড়িমারী স্থলবন্দরে আটকে গেছে খাদ্যপণ্যবাহী ২০টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান। এর মধ্যে ১০টি খালি ট্রাক রয়েছে। যানগুলো রবিবার বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল। বুড়িমারী কাস্টম কর্মকর্তা রাশেদ জানান, ভারতে রপ্তানির জন্য প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, সজীব গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপের ২০টির মতো বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যবোঝাই ট্রাক আটকা রয়েছে। শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব পণ্যবাহী ট্রাক বুড়িমারী স্থলবন্দরে এসে পৌঁছায়। এ ছাড়া বেনাপোলে তৈরি পোশাক বোঝাই ৩৬টি ট্রাক আটকে রয়েছে। সেগুলো ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। রপ্তানিকারকরা বলেন, ভারতের এই প্রজ্ঞাপনে রপ্তানিমুখি তৈরি পোশাক কারখানা ক্ষতির মুখে পড়বে। বেনাপোল স্থলবন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে পণ্য ভারতে পাঠাতে দ্বিগুণ খরচ হবে। একই সঙ্গে পণ্য পৌঁছাতেও কয়েক গুণ বেশি সময় লেগে যাবে। এতে ক্রয়াদেশ কমে যাবে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও তুলার সুতার ঝুট ও ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়। স্থলবন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য বেশি রপ্তানি হতো। এখন স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত। ফলে এসব পণ্যের রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
উল্লেখ্য, শনিবার বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রীসহ কিছু পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ভারতের স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস) বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত ও আসবাব রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরাও সুতা আমদানি বন্ধ করেছি। এখন ওরা বন্ধ করেছে। এটার তো কোনো শেষ নেই। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। কিছুটা তো আমাদের ওপর প্রভাব পড়বেই। ভারতে আমরা বড় অঙ্কের পোশাক রপ্তানি করি। প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। সেখানে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে রপ্তানিকারকদের ওপর।
প্যানেল