বীমা দিবস ২০২৪
দেশে জীবন বিমা পলিসি নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানুষের আস্থাহীনতা। এর বাইরে দাবি নিষ্পত্তিতে কোম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অনীহা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং বিমা কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা না পাওয়াও বিমা খাতের বিকাশে বাধা হয়ে আছে।
সহজ করে বললে, দাবি পরিশোধ না করতে পারাই বিমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থাহীনতার বড় কারণ। এ কারণে দেশের মানুষের মধ্যে জীবন বিমা গ্রহণের হার বাড়ছে না। মানুষ মনে করেন, ঝুঁকি দূর করতে গিয়ে আবার ঝুঁকি নেব নাকি। যদিও বিমা খাতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বিমার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। এখনো পর্যন্ত বিমা কোম্পানি কাজ করছে ৮১টি। কিন্তু ৫০ বছরের বেশি সময় পার হলেও বাংলাদেশের বিমা খাত সেভাবে বিস্তৃত হয়নি। সরকারি হিসেবে বিমার আওতায় আছেন মাত্র ১ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার মানুষ। উন্নত বিশ্বে ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু কিংবা দুর্ঘটনাজনিত আর্থিক ক্ষতি কমাতে জীবন বিমা প্রচলিত একটা মাধ্যম। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির ব্যয়ের বোঝা কমাতে স্বাস্থ্যবিমা অনেক দেশেই ব্যাপক প্রচলিত।
কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও বিমা খাত সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ২০০৮ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে জীবন বিমার গ্রাহক ছিলেন দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে সেটি কমে দশমিক ৩৮ শতাংশ হয়। ২০২২ সালে সেটি আরও কমে দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যায়। একইভাবে সাধারণ বিমা গ্রাহকের সংখ্যাও কমেছে। অথচ বিমার গ্রাহক ১ শতাংশ বাড়লে দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আজ শুক্রবার ঢাকাসহ সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় ৫ম জাতীয় বিমা দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। বিমা দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘করব বিমা গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’।
জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিমা খাত দীর্ঘদিন চললেও এই খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং আইন তৈরি হয় ২০১০ সালের পরে। আর জাতীয় বিমা নীতি এসেছে ২০২৩ সালে। এতদিন বিমা খাতে প্রতারণা এবং দুর্নীতি চললেও সেটা যে কার্যকরভাবে ঠেকানো যায়নি তার বড় কারণ কার্যকর কোনো আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানি কাঠামো না থাকা। ২০১০ সালের পর সেটা শুরু হলেও আইন এবং প্রতিষ্ঠান গোছাতেই শেষ হয়ে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়।
জানতে চাইলে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, যেসব কোম্পানি প্রতারণা করেছে তাদের পার পাবার সুযোগ নেই। এখানে ১৯টা কোম্পনি আছে, যাদের বিমা দাবি পরিশোধের হার কিন্তু ৮২-৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি আছে যারা খারাপ করছে। তাদের সংখ্যা বেশি নয়। তাদের দাবি পরিশোধের হার খুবই কম। তিনি বলেন, এর কারণ হলো দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফলে এসব কোম্পানি তাদের আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা অনেকগুলো কোম্পানি যাদের স্থাবর সম্পত্তি ছিল, সেগুলো বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছি এবং সেটা পর্যায়ক্রমে তারা করছে।
তিনি বলেন, বিমা কার্যক্রমে ভবিষ্যতে দুর্নীতি এড়াতে আরও দুটো জিনিস করা হচ্ছে। এক. সব কোম্পানির জন্যই বিমার টাকা জমা দেয়ার প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার অধীনে আনা যেন টাকা জমার তথ্য তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়। এখনো অনেক কোম্পানি এর আওতায় নেই। দুই. পলিসি বিক্রয়ের জন্য বিমা খাতের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করা। অর্থাৎ ব্যাংক থেকেই বিমার জন্য নতুন গ্রাহক খোঁজা হবে।
ব্যাংক এতে অনেকটা বিমা কোম্পানির অ্যাজেন্টের ভূমিকায় থাকবে। এতে করে অ্যাজেন্টদের কমিশন ব্যাংক পাবে। অন্যদিকে পলিসি এবং টাকা জমাসহ সবকিছু ব্যাংকিং সিস্টেমে থাকায় প্রতারণা বন্ধ হবে।
বাংলাদেশে বিমা খাত নিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ। সেই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভাগটির ডিন মো. নুরুল কবীর। তাদের গবেষণাতেও বাংলাদেশে বিমা খাতের বিস্তার না হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আস্থাহীনতার কথা। আর এই আস্থাহীনতার মূল কারণ পাওনা দাবি নিষ্পত্তিতে জটিলতা।
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় মানুষ যেটা বলেছে যে, আমরা ইন্সুরেন্স কন্টিনিউ করছি, কিন্তু যখনই আমার প্রয়োজনটা দেখা দিচ্ছে অর্থাৎ কোন দুর্ঘটনা ঘটছে, তখন আমরা কোম্পানির কাছে যাচ্ছি। কিন্তু টাকাটা আমি পাচ্ছি না। এখান থেকে ওখানে ঘুরাচ্ছে। তাহলে যে ঝুঁকিটা মেটানোর জন্য আমি ইন্সুরেন্সটা করলাম, আমার তো সে উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। তখনই হচ্ছে, মানুষের কাছে নেগেটিভ ইম্পেশনটা অনেক বেশি ছড়িয়ে যায়।’
বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত বিমা কোম্পানি গড়ে উঠেছে ৮১টি। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বিমা ব্যবসা নিয়ে যে র্যাঙ্কিং সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫ তম। এ ছাড়া বিমা খাতে মোট সম্পদের যে প্রবৃদ্ধি সেটা যেমন কমছে, তেমনি প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রেও সেভাবে অগ্রগতি নেই। ফলে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, অঙ্গহানিসহ এধরণের ঘটনায় বিমা না করায় আর্থিক সুবিধার বাইরেই থাকছেন অধিকাংশ মানুষ। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিমার প্রসার না ঘটায় চিকিৎসা খাতেও মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে।
সর্বশেষ সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একজন মানুষের চিকিৎসার পেছনে যে ব্যয় হয়, তার ৬৯ শতাংশই যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. নুরুল কবীর বলছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিমার আওতায় থাকলে সেটা তার চিকিৎসা খরচের বোঝা কমাতে সাহায্য করত।
কিন্তু মানুষের মধ্যে সে বিষয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বিমা করলে কী উপকার হবে, বিমা পলিসি কখন, কী কারণে বাতিল হবে, এটা যে সাধারণ ব্যাংকে টাকা জমানোর মতো সিস্টেম না -সেসব বিষয়ে কোম্পানির অ্যাজেন্টরা অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেন না গ্রাহকদের। বিমার পলিসিগুলো সাজানো-গোছানো। কিন্তু যেভাবে এটা বর্ণনা করা হয়, সেটা বোঝাটা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। অ্যাজেন্টরাও এক্ষেত্রে সব তথ্য দেয় না।