ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পণ্য বহুমুখীকরণে জোর দেয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

রফতানি আয়েই আশার আলো

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ৪ জুলাই ২০২২

রফতানি আয়েই আশার আলো

রফতানি

করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখছে বিশ্ববিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যে চূড়ায় অবস্থান করছে মূল্যস্ফীতিসাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত মে মাসেগত জুনে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে

অর্থনৈতিক এমন সঙ্কটের মধ্যেই আশার আলো জ্বেলেছে রফতানি আয়গত অর্থবছর শেষে ৫২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে দেশের রফতানি আয়রফতানি করা পণ্যের মধ্যে ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাকঅর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে রফতানি আয় যে ৫২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে, তা একটি বড় অর্জনসরকার রফতানি বাড়াতে বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণ ও আর্থিক প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে

করোনার পর সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছেসেই চাহিদার কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিলসবশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘিœত হওয়ায় আরও চড়ছে দামপাশাপাশি জাহাজ ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছেসব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে নতুন উচ্চতায় উঠেছেগত বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার

সোমবার সেই তেল ১০৯ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছেরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে এর দর ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিলমহামারীর পর চাহিদা বাড়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ছাড়াও খাদ্যপণ্য (বিশেষ করে গম), ভোজ্যতেল, শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি), শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালসহ সব ধরনের জিনিসের দামই বেড়েছেএখনও বেড়েই চলেছেমে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছেবাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী আট বছরের মধ্যে দেশে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতিএর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ

করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থনীতির প্রতিটি সূচক বিধ্বস্ত হলেও চাঙা ছিল দেশের রেমিটেন্সপ্রবাহকিন্তু সদ্যবিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধির ধারা নি¤œমুখী হয়গত অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরাঅর্থবছরের শেষ মাস জুনে ১৮৩ কোটি ৭৩ লাখ (১.৮৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের জুনের চেয়ে ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ভাটা পড়লেও গত অর্থবছরে আশার আলো জ্বেলেছে রফতানি আয়গত অর্থবছর শেষে ৫২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে দেশের রফতানি আয়এই অঙ্ক আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশিবাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক বছরে পণ্য রফতানি থেকে এত বেশি বিদেশী মুদ্রা দেশে আসেনি

রফতানি করা পণ্যের মধ্যে ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক, যার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ২৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারপ্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৮ শতাংশলক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ১৯ শতাংশওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারপ্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশলক্ষ্যের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ২৪ দশমিক ১২ শতাংশ

একক মাসের হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও পণ্য রফতানিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশএই মাসে ৪৯০ কোটি ৮০ লাখ ৩০ হাজার (৪.৯১ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রফতানি করেছেন রফতানিকারকরা, যা গত বছরের জুন মাসের চেয়ে ৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ বেশিআর নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে ৩৫ শতাংশএই মাসে পণ্য রফতানি থেকে ৩৬৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার

গত বছরের জুন মাসে ৩৫৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছিলরাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও জুন মাসে রফতানিতে এই উল্লম্ফন অর্থনীতিবিদ ও রফতানিকারকদের অবাক করে দিয়েছেএই ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি প্রবৃদ্ধি রফতানির চেয়ে এখনও অনেক বেশিএখানে ভারসাম্য রক্ষা না হলে সুফল আসবে নাআমদানি বেশি হওয়ায় রিজার্ভ ঘাটতি পড়ে যাচ্ছেরফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসছে পোশাক খাত থেকেএকটি খাতের ওপর বছরের পর বছর ধরে নির্ভর থাকলে ঝুঁকি থাকেই

কোন কারণে এই খাতে ধস নামলে বিপদে পড়তে হবেরফতানি বৈচিত্র্য খুব জরুরী এখনইলেক্ট্রনিক্স, খাদ্যদ্রব্য, চামড়া শিল্প, চা, চামড়ার গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে রফতানি আয় বাড়ানো দরকার’ ‘বাজারের পরিধি বাড়াতে হবেইউরোপীয় ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্র আমাদের প্রধান বাজারজাপান, কোরিয়া, চীনের বাজারও ধরতে হবেসফল হয়নিকিন্তু হাল ছাড়া যাবে নাবাজারের পরিধি বাড়াতেই হবে

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিটেন্সে হঠা যে উল্লম্ফন হয়েছিল, তার একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিলওই বছরের পুরোটা সময় কোভিডের কারণে পুরো বিশ্ব কার্যত বন্ধ হয়ে যায়সে কারণে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানোও বন্ধ ছিলপ্রবাসীরা সব টাকা পাঠিয়েছিলেন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেসে কারণেই রেমিটেন্স বেড়েছিল

আর কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি থাকায় এখন আগের মতো অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরাতাই বৈধপথে রেমিটেন্স কম এসেছেএর ফলে সামগ্রিকভাবে রেমিটেন্স কম এসেছেতিনি বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাব রফতানি আয়ে পড়বেতবে আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রফতানি খুব একটা কমবে নাকেননা, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও দেশটির অর্থনীতিতে কোন সঙ্কট নেইসে কারণে ওই দেশের লোকজন পোশাক কেনা কমিয়ে দেবে- এমনটা আমার কাছে মনে হয় নাবাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত জনকণ্ঠকে বলেন, অনেকদিন থেকেই আমরা চেষ্টা করছি, পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ বাড়ানোর

পোশাক খাতের ভেতর এবং বাইরেও চেষ্টা করছিতিনি বলেন, আমাদের কৃষিপণ্যের বাজারে বিপুল সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছেআরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে চামড়া খাতযদিও এ খাতের জন্য আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনিট্যানারি পল্লীর সিইটিপি আমরা এখনও কার্যকর করতে পারিনিতাই রফতানিতে বৈচিত্র্যতা ফিরছে এটা যেমন সত্যি, তেমনি এতে খুশি হওয়ার কোন কারণ নেইকারণ, আমাদের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবেরফতানির এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে পোশাক খাতের মতো অন্য রফতনিমুখী খাতগুলোকেও একই সুবিধা দিতে হবেযেমন ব্যাক টু ব্যাক এলসি, বন্ডেড ওয়্যার হাউস, ডিউটি ফ্রি এক্সেস ইত্যাদিএসব সুবিধা দিলে সম্ভাবনাময় অনেক পণ্যই রফতানিতে ভাল করতে পারবে

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগ বাংলাদেশের রফতানি খাত দুভাবে নিতে পারেপ্রথমত, সীমিতভাবে ক্রয়াদেশ বেশি নিতে পারেন উদ্যোক্তারাদ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে বিদেশী বিনিয়োগকে আকর্ষণ করাএ জন্য আগামী দিনের পণ্যের উসের হাব হিসেবে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে হবেকারণ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, পেট্রো-কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, চামড়া, হালকা প্রকৌশল, সিরামিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বড় সুযোগ রয়েছে

তিনি বলেন, তৈরি পোশাকবহির্ভূত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বাজারভিত্তিক, পণ্যমানভিত্তিক ও শুল্কবহির্ভূত বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করা বিশেষ প্রয়োজনতিনি বলেন, সব পণ্যের বাজারে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা খুব সীমিত আকারেই রফতানি বাড়াতে পারছে ভিন্ন ভিন্ন কারণেঅপ্রচলিত প্রায় প্রতিটি বাজারে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছেএ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ যেমন- চীন বা ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ তা পর্যাপ্ত আকারে ব্যবহার করতে পারে নাকৃষিজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে স্যানিটারি ও ফাইটো স্যানিটারি স্ট্যান্ডার্ড পরিপালন গুরুত্বপূর্ণ

×