ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোরবানি কেন্দ্রিক অর্থনীতি

জলি রহমান

প্রকাশিত: ২১:১৭, ২ জুলাই ২০২২

কোরবানি কেন্দ্রিক অর্থনীতি

ঈদের আনন্দ

পুরনো ছন্দে ফিরে এলো ঈদের আনন্দমুসলিমদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উসবের মধ্যে একটি ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদপর পর দুটি কোরবানির ঈদের আনন্দকে নির্জীব করে রেখেছিল করোনাএবারও শঙ্কা মুক্ত হওয়া যায়নি।  কেননা করোনা উর্ধমুখীযেহেতু লকডাউন নেই এবং জনসাধারণ আগের থেকে অনেক সচেতনতাই বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালিত হলে সবাই কাক্সিক্ষত পশুটি কিনে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেঈদ-উল -ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা এই দুটো উসবেই অর্থ প্রবাহ বেড়ে যায় বহুগুণরেমিটেন্সসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে দেখা দেয় চাঙ্গাভাব । 

প্রান্তিক জনগণের কোরবানি : ঈদ-উল-আজহার আনন্দ পরিবার ভেদে বিভিন্ন রকমের হয়যখন শহরের ধনী পরিবারগুলো ভাবছে এবার পশু কিনতে বাজেট কত হবেতখন গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবার হিসেব করছে কত টাকায় বিক্রি করলে কিছুটা লাভ হবেঅনেক সময় তারা লাভবান হয় আবার অনেক সময় চরম হতাশায় পরিণত হয় সবকিছুতবে এই সংখ্যাটা হাতে গোনাকেননা সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি করেতাই কোরবানি হওয়া পশুর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়েবহু হতদরিদ্র পরিবার সারা বছর খুব যতেœ পশু পালন করে এই সময়টার জন্যসন্তানের মতো লালন-পালন করা পশুটি বিক্রি করে যে লাভ হয় তা দিয়ে বড় কোন প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়এজন্য এই ঈদ একেকজনের কাছে একেক রকমশহর থেকে অনেক মানুষ গ্রামে যায় ঈদ করতেতারা পশু কোরবানি করে সকল দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ফলে সারা বছর যাদের পক্ষে গরু বা খাশির মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় নাতাদের এই সময়ে মাংস খাওয়ার সুযোগ হয়এভাবেই ঈদের আনন্দ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার মাঝে ভাগাভাগি হয়

বাড়ছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা : যে কোন ঈদে ঢাকায় বেচা-কেনা বেড়ে যায় বহুগুণরোজার ঈদে পোশাক ক্রয়-বিক্রয় এবং যাকার-ফিতরার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে যায়কোরবানিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় পশু ক্রয়-বিক্রয়ফলে অর্থপ্রবাহ অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বাড়েগত দুই বছর পশু কোরবানির সংখ্যা কমেছিল মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কম থাকায়এবার বাড়বে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরাপ্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ এবং ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখএভাবে ক্রমাগত পশু কোরবানির সংখ্যা বাড়তে থাকে২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিড ১৯ সংক্রমণ মানুষের জীবন যাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলায় পশু কোরবানির সংখ্যা কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩২০২১ সালে পশু কোরবানির সংখ্যা আরও হ্রাস পেয়ে হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টিকোরবানিযোগ্য অবিক্রীত পশুর সংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টিফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছিল খামারি-ব্যাপারীরাএবার গরুর দাম বেশি হবেকেননা গো-খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০-৪০০ টাকাতথ্য মতে, এবার ঈদ-উল-আজহায় ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু কোরবানি দেয়া হবেএর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজারপ্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির জন্য ইতোমধ্যে ৪২ লাখ ৪০ হাজার গরু-মহিষ ও ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ছাগল-ভেড়া মোটাতাজাকরণ করা হয়েছেএখন অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছেমানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছেআশা করা যায়, গতবারের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন খামারিরা

বাজার ব্যবস্থাপনা : পবিত্র ঈদ-উল-আজহায় সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে পশুর হাটপ্রতিটি জেলা-উপজেলায় মাঠ, ঘাট, পথে পশুর হাট বসানো হয়এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা প্রয়োজনরাজধানী ঢাকায় এবার কোরবানির পশুর ১৭টি অস্থায়ী হাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছেঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বসবে ১০টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) বসবে ৭টি পশুরহাটপ্রয়োজনে হাটের সংখ্যা বাড়তে পারেবরাবরের মতো চালু থাকবে ডিএনসিসির ডিজিটাল হাটই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এবং বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের খামারিরা পশু বিক্রি করতে পারবেন ডিজিটাল হাটে

সম্পূর্ণ দেশীয় পশুতে কোরবানি : ২০১৪ সালে বৈধপথে অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় ভারতীয় গরু আমদানিপশুর সরবরাহ কম থাকায় বৈধ ও অবৈধ উপায় অবলম্বন করে আরও কয়েক বছর পশু আমদানি করা হয়েছিল২০১৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ দেশীয় পশুতে কোরবানি করা হয়যা সম্ভব হয়েছিল মস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের যথাযথ পদক্ষেপের জন্যএবারও দেশীয় পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ হবে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের

অনলাইন বেচাকেনা : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল হিসেবে দুনিয়াটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছেযে কোন প্রয়োজন এখন ঘরে বসেই মেটানো যায়নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে বিলাসবহুল পণ্য সবকিছুই অর্ডার অনুযায়ী পৌঁছে যাবে ঘরে২০২০ সালের আগ পর্যন্ত অনলাইন কেনাকাটা ঢিলেঢালা চলছিলকরোনা অনলাইন ব্যবসায় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে২০২০ সালের মার্চ থেকে অনলাইনে কেনাকাটা প্রচুর বেড়ে যায়২০১৫ সাল থেকে অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি শুরু হলেও গত দুবছরে অনলাইনে কেনাবেচা খুবই চাঙ্গা হয়ফলে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছেএ বছর কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল পশুর হাট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকারডিজিটাল হাটনামক এই পশুরহাট আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়এছাড়াও বিভিন্ন খামারিরা নিজস্ব অনলাইন পেইজ থেকে পশু বিক্রয় করছেনঅনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রথম সারির ই-কমার্স প্লাটফর্ম হলো- বিক্রয় ডটকম, বেঙ্গল মিট, কিউকম ডটকম, ডিজিটাল হাট, দারাজ গরুর হাট, প্রিয়শপ, দেশী গরু, মাদল, হেক্সা ট্রেডিং, ই-বাজার, অথবা ডটকম, সদাগর, আজকের ডিল ইত্যাদি।   চামড়ার বাজার : করোনার কারণে টানা দুই বছর (২০২০ ও ২০২১ সালে) চামড়ার ব্যবসা খুব একটা ভাল হয়নিঅনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী এ দুই বছরের কোরবানির পশুর চামড়া কিনে লোকসানে পড়েছেন২০২০ সালে অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছেনতবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্নএরইমধ্যে চামড়ার দাম বাড়ার পাশাপাশি রফতানি আয়ও বেড়েছেফলে এ বছর কোরবানির ঈদে চামড়ার ভাল দাম পাওয়ার সম্ভাবনা২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে চামড়ার বেচাকেনা ভাল হয়েছেবাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) জানায়, এবার ব্যবসা আরও ভাল হবেচামড়া সংরক্ষনে লবনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছেআসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি  নেয়া হয়েছে

×