প্লাস্টিক হলো বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ আবিষ্কার যা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে এবং আমাদের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে নিয়ে এসেছে। আজকের বিশ্বে প্লাস্টিক সর্বব্যাপী জীবনের মান উন্নয়নে অবদান রাখছে। পোশাক থেকে আশ্রয়, যোগাযোগ থেকে পরিবহন, বিনোদন থেকে স্বাস্থ্যসেবা এমন কোন মানবিক ক্রিয়াকলাপ নেই যেখানে প্লাস্টিক ভূমিকা পালন করে না। প্লাস্টিকের এই বহুবিধ ব্যবহারের কারণ হলো- হালকা ওজন, সহজে প্রক্রিয়াকরণ এবং মজবুত। কম খরচ, সহজ উৎপাদনযোগ্যতা, বহুমুখিতা, পানির সঙ্গে সংবেদনহীনতা, বহনযোগ্যতা ইত্যাদি কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে পলিমারের তৈরি প্লাস্টিক সামগ্রী। ১৯৫০ সালে যখন প্রথম প্লাস্টিকের উৎপাদন শুরু হয়, তখন থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে হিসাব করলে এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত একশ পঁচাত্তর মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। প্লাস্টিকের এই যুগে প্লাস্টিক, রাবার ও সিনথেটিক ফাইবার ছাড়া জীবন-মান অনেকাংশেই দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।
প্লাস্টিক মূলত এক ধরনের পলিমার। প্রকৃতি বহু শতাব্দী ধরে এই প্লাস্টিক জাতীয় উপকরণ ব্যবহার করে আসছে। প্লাস্টিকের বহুবিধ ব্যবহার অনেকাংশেই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে যাচ্ছে, উদাহরণস্বরূপ- ভোজ্যতেল এবং দুধের প্যাকেজিং নমনীয় ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের ব্যবহার টিন ও কাচের ব্যবহার কমিয়েছে। তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী এবং হালকা বলে বর্তমানে কাঠের পাশাপাশি প্লাস্টিকের আসবাবপত্র এবং উপকরণের বাজারও বেশ ভাল। এসব আসবাবপত্র ও উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল, সোফা, আলমারি, ওয়ারড্রোব, কিচেন রেক, লন্ড্রি বাস্কেট, বালতি, স্টোরেজ বক্স, হটপট, ড্রাম, কনটেইনার ইত্যাদি।
হাই-ডেনসিটি পলি ইথিলিন ব্যারেল ব্যবহার করা হচ্ছে কেমিক্যাল স্টোরেজের জন্য যা স্টিল ড্রামের বিকল্প হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা ছাড়াও আধুনিক শিল্প ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ওজনে তুলানামূলক হালকা হওয়ায় অটোমোবাইল এবং বিমানের মতো শিল্পগুলিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে উচ্চ গতি এবং জ্বালানি দক্ষতা দুটিই অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক শিল্প কারখানাগুলো ভারি ধাতুর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত হালকা প্লাস্টিকের পলিমার ব্যবহার করছে।
প্লাস্টিক ব্যাগ, পলিব্যাগ বা থলি এমন এক ধরনের পাত্র যা পাতলা, নমনীয়, প্লাস্টিকের ফিল্ম, নন ওভেন ফেব্রিক বা প্লাস্টিকের টেক্সটাইল দিয়ে তৈরি। প্লাস্টিকের ব্যাগ সাধারণত খাদ্য, উৎপাদন, গুঁড়া, বরফ, ম্যাগাজিন, রাসায়নিক এবং বর্জ্য হিসাবে পণ্য ধারণ ও পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্যাকেজিংয়ের একটি সাধারণ রূপ। নির্মাণের উপর নির্ভর করে, প্লাস্টিকের ব্যাগগুলো প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে চামড়াবিহীন জুতা তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে কৃত্রিম চামড়া (সিনথেটিক), রাবার, প্লাস্টিক কিংবা কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। সেগুলো রফতানি হচ্ছে বিশ্বের নামী ব্র্যান্ডগুলোর কাছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াবিহীন জুতা রফতানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। জুতা রফতানির মোট আয়ের ৩০ শতাংশ এসেছে চামড়াবিহীন জুতা থেকে। বিশ্বখ্যাত জুতা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান এডিডাস সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে জুতা উৎপাদন করে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। অন্য অনেক বস্তু যে সুবিধা দিতে পারে না, একসঙ্গে বহুমুখী কর্মক্ষমতা সম্পন্ন প্লাস্টিক সেই সুবিধা প্রদান করে বলেই ডিজাইনার ও ইঞ্জিনিয়ারদের এত পছন্দের প্লাস্টিক। আধুনিক ভবন এবং নির্মাণগুলোতে কাঠের পরিবর্তে প্লাস্টিকের দরজা, জানালা, মেঝে এবং প্রাচীরের আচ্ছাদনগুলো ব্যবহার করে বৃক্ষ সংরক্ষণে অবদান রাখছে।
প্লাস্টিকহীন কোন কিছুই খুঁজে পাওয়া আমাদের জন্য নিষ্ফল এক আবেদন। বাংলাদেশ নয় শুধু গোটা উন্নয়নশীল আর অনুন্নত বিশ্বে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। বাচ্চাদের খেলনা সামগ্রী তৈরির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বিকল্প নেই কারণ প্লাস্টিকের খেলনা সহজে ভাঙ্গে না এবং কম দামেই ছোটখাট খেলনা পাওয়া যায়। দামে সস্তা ও রঙিন প্লাস্টিকের খেলনা গ্রাম বা শহর দুই জায়াগার বাচ্চাদের কাছেই সমান জনপ্রিয়। উন্নতমানের প্লাস্টিক দিয়েখেলনা তৈরি করতে পারলে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসেবা খাতেও রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। রক্ত ব্যাগ, টিউবিং, হার্ট ক্যাথেটার, ডিসপোজাবল পণ্য (গাউন, মাস্ক, সিরিঞ্জ) ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় কারণ এগুলো যেমন সহজ, স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও নিরাপদ।
অধিকাংশ প্লাস্টিকই তৈরি হয় পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থ থেকে। প্লাস্টিকের এই উৎপাদন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলছে তা কিন্তু নয়। মোট উৎপাদিত পেট্রোলিয়াম এর মাত্র ৫% ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিক উৎপাদনে। অনেক প্রাকৃতিক উপকরণ (গ্যাস, কাগজ, কাঠ, ধাতু) প্রক্রিয়াকরণ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রাপ্ত শক্তি অনেক বেশি ব্যবহার করে। সুতরাং প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে অনেকাংশেই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমানো যায় যা টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
উন্নত দেশগুলোতে টেকসই উন্নয়নে রাস্তা তৈরিতে ব্যবহার করছে প্লাস্টিক। বিটুমিন নামের এক কালো হাইড্রোকার্বন আর নুড়ি পাথরের মিশ্রণ রাস্তায় বিছানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে বিটুমিন আর পাথরের মিশ্রণে গলিত প্লাস্টিক মেশানো হলে প্লাস্টিক এই দুই উপাদানকেই ধরে রাখে। বিটুমিন-মডিফাইড প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে টেনসাইল স্ট্রেংথ বৃদ্ধি পাবার ফলে রাস্তা হয় আরও বেশি নমনীয়, ঘাতসহ ও টেকসই। বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো রাস্তায় খানাখন্দের উৎপত্তিও হয় না। আর বিটুমিন ও নুড়ি পাথরের মিশ্রণের উপাদানগুলোর মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা গলিত প্লাস্টিক পূরণ করে দেয়ার ফলে জমে থাকা পানি থেকে অবকাঠামোগত ত্রুটিও দেখা দেয় না।
পেট বোতল ভোক্তাকে আস্থা প্রদান করে যাচ্ছে পানীয় জল সংরক্ষণ করে ব্যবহার করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগ হ্রাস করতে সহায়তা করছে। ফাইবার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্লাস্টিকের বোতল।
কাঁচামাল হিসেবে প্লাস্টিকের ফেলে দেয়া বোতল ব্যবহার করায় পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ ফাইবার বানাতে যে ধরনের বোতল ব্যবহৃত হয় তা মাটির সঙ্গে মেশে না। ফলে পরিবেশের ব্যাপক দূষণ করে এটি। সেজন্য পরিবেশ সুরক্ষায় ফেলে দেয়া এই বোতল কারখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে কাঁচামাল হিসেবে। এছাড়া ফাইবার বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: