ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পল্লীবান্ধব সোয়ালোজ

মামুন-অর-রশিদ

প্রকাশিত: ০১:২৮, ৬ নভেম্বর ২০২২

পল্লীবান্ধব সোয়ালোজ

রাজশাহীর চারঘাটের থানাপাড়ায় সোয়ালোজ কারখানায় ব্যস্ত হাস্যোজ্জ্বল এক নারী

‘সোয়ালোজ’। সুইডেনের একটি পাখির নাম। সুইডেন ভাষায় একে সুখের পায়রা বলা হয়। প্রচার রয়েছে চরম সংকটকালে সোয়ালোজ উড়ে এসে সুখের পথ দেখায়। সুখের নাগাল পাইয়ে দিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। বিষয়টি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হলেও রাজশাহীর চারঘাটের থানাপাড়ায় সোয়ালোজ শব্দটি বাস্তবতার স্বাক্ষর রেখেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত চারঘাটের থানাপাড়ায় আলোর পথ দেখিয়েছে সোয়ালোজ। এখানে কাজ করে বিশেষ করে হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পুরো গ্রামই এখন সুখী হয়ে উঠেছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গড়ে ওঠা সোয়ালোজ নামের এ কারখানা থেকে তৈরি আন্তর্জাতিক মানের পণ্য এখন দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বের ৮টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ইচ্ছেশক্তির কারণে এখানে নারী পুরুর একসঙ্গে কাজ করে তাক লাগিয়েছে বিশ্বকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিধবা পল্লী নামের এ গ্রামে ধরা দিয়েছে সুখের পায়রা।
চারঘাটের থানাপাড়ার সোয়ালোজ মূলত সুইডেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান। গত মাসের ১৭ অক্টোবর এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে পণ্য তৈরি ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রদানের পাশাপাশি সামাজিক কাজ যেমন, নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ের বিষয়ে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মাহমুদা আখতার গিনি। এ প্রতিষ্ঠানে গানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ মার্চ। এরপর কর্মদক্ষতা এবং নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে ১৯৭৯ সালে পোগ্রাম অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। তার স্বামী রায়হান আলী শুরু থেকেই পরিচালক ছিলেন। এখন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় বর্তমান পরিচালক মাহমুদা আকতার গিনি। সবায় তাকে ‘গিনি আপা’ বলেই চিনেন। তার হাত ধরেই এখন এগিয়েছে সোয়ালোজ। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন সুখের হাতছানি।

পরিচালক মাহমুদা আখতার গিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধের পর গ্রামের নারীরা অনেকটাই অহসায় ছিল। সোয়ালোজ এখানকার নারীদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই সোসাইটির নারীরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশেষ পরিচিতিও দিচ্ছেন।
মাহমুদা আকতার গিনি বলেছেন, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার পৌর সদরের গ্রামটির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এক সুইডিস দম্পতির। তাদের নাম ছিল রয় ও অনিতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামটির অবস্থা দেখার জন্য পাঠানো হয়েছিল তাঁদের।  তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এ গ্রাম। বলতে গেলে পুরো গ্রাম পুরুষশূন্য।

এ গ্রামের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলেন রয় ও অনিতা দম্পতি। তারা ত্রাণ নিয়ে এসেছিলেন। তখন গ্রামের নারীরা এক হয়ে তাদের জানাল ‘ত্রাণ নয়, কাজ চায়’। এতেই সুইডিস দম্পতি অনুধাবন করে গ্রামটির মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সেই চাওয়া পূরণ করতেই প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘সোয়ালোজ আন্দোলন’।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে যে গ্রামটিকে পুরুষশূন্য করে ফেলেছিল, সেই গ্রামটি এখন দুনিয়ার হাজারো মানুষের জন্য এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। দেশী-বিদেশী বন্ধুদের হাত ধরে সেই গ্রামটি এখন হস্তশিল্পের জন্য ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে।
মাহমুদা আকতার গিনি বলেছেন, সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি নামের একটি বেসরকারি সংগঠন যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামটির ভাগ্য বদলে দিয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। ’৭১ -এ স্বজন হারানো এ গ্রামের নারীরা এখন অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ১৯৭২ সালেই সুইডেনের ‘সোয়ালোজ’ নামের সংস্থাটি দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে রিলিফ প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে। সারদার থানাপাড়া এমনই একটি গ্রাম ছিল।

স্বামী, ভাই বা সন্তান হারা এরকম ১৭ জন নারীকে হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়। গঠন করা হয় ‘দি সোয়ালোজ থানাপাড়া প্রজেক্ট’। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রজেক্টটি সুইডেন থেকে সরাসরি পরিচালিত হতো। পরে ঢাকা থেকে এবং বর্তমানে স্থানীয় জনবল তৈরি করে তাদের মাধ্যমেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে প্রজেক্টের পরিবর্তিত নামকরণ করা হয় ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’।

পর্যায়ক্রমে যুদ্ধবিধ্বস্ত এ গ্রামের ক্ষতিগ্রস্তরা প্রায় সকলেই এই সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। বর্তমানে এ গ্রামের তিন শতাধিক নারী সোয়ালোজ সোসাইটিতে হস্তশিল্পের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করছে। নারীদের পাশাপাশি অর্ধশত পুরুষও কাজ করছেন এখানে।
গ্রামের ভিতরে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে কারখানাটি অবস্থিত। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় সেখানে সবাই কর্মচঞ্চল। সবকিছু দেখভাল করেন পরিচালক মাহমুদা আকতার গিনি। ভিতরে সবাই সৃষ্টির নেশায় ব্যস্ত। কেউ চরকা ঘুরিয়ে সুতা কাটছেন, কেউ কাপড় বুনছেন, কেউ কাপড়ে মাড় দিচ্ছেন অথবা কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে বুনানো কাপড়ে নকশা করছেন।
কারখানায় শুধু সুতাটাই বাইরে থেকে ক্রয় করা হয়। বাকি সবই এখানকার নারীরা করে থাকেন। সকল প্রকার গার্মেন্টেসের পাশাপাশি নকশী কাঁথাও তৈরি করা হয় এখানে। এখানকার তৈরি হস্তজাত পণ্য উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। বিদেশের যেসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থানাপাড়ার হস্তশিল্প ক্রয় করে থাকেন সেগুলো হলো জাপানের কেয়ার ট্রেড কোম্পানি, হল্যান্ডের পিপল ট্রি, ফ্রিনল্যান্ডের দি সোয়ালোজ ইন ফিনল্যান্ড, ইতালির ফেয়ার কো-অপারেশন ডেনমার্কের মাদার, কোরিয়ার ফেয়ার ট্রেড, সুইডেনের  মেলেনিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার ভালো। দেশীয় উন্নত শপিংমলগুলোতেও এই হস্তশিল্প জায়গা করে নিয়েছে।
সোয়ালোজের পরিচালক বলেছেন, এখানে সমবণ্টন নীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে শ্রমিকরা সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকেন। ফলে ফড়িয়া শ্রেণি বা মধ্যস্থতাকারীদের কোনো হাত থাকে না। সোসাইটির আয়-ব্যয় নির্ধারণেও শ্রমিকদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। কোন দাতা সংস্থার তরফ থেকে পাওয়া অনুদানের পুরোটাই শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়।

নারীদের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নানা রকম উন্নয়নমূলক কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে সোয়ালোজ। এর মধ্যে হস্তশিল্প প্রকল্প, গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প, প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ডে-কেয়ার এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
এসব কর্মসূচির আওতায় সোয়ালোজ যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তা হলো স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প, আইন শিক্ষা, আর্সেনিক পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, দক্ষতা উন্নয়ন, উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং পারিবারিক সহিংসতা রোধ প্রকল্প। প্রকল্পের আওতায় আশপাশের দশটি গ্রামে ঝড়ে পড়া শিশুদের নিয়ে একটি করে স্কুল তৈরি করা হয়েছে।
সোয়ালোজের সুবিধাভোগী জাহানারা বেগম নামের একজন নারী ২৩ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন। জাহানারার বাবা জালাল উদ্দিন একাত্তরের ১৭ এপ্রিল হত্যাকা-ের শিকার। বাবা নিহত হওয়ার দু’বছর পর জাহানারার মা কারখানায় যোগদান করেন। বয়স হলে মায়ের সঙ্গে তিনিও চাকরি নেন। চাকরি নেওয়ার দু’বছর পর বিয়ে হয় জাহানারার। জমানো টাকা দিয়ে সারদা বাজারে স্বামীকে দোকান করে দিয়েছেন জাহানারা। তিনি বলেছেন, সোয়ালোজ সোসাইটি এখানকার নারীদের চোখ খুলে দিয়েছে।

×