ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাতা কুঁড়ির বঞ্চনা ৪

চা রফতানি কমছে, আমদানি বাড়ছে

রহিম শেখ

প্রকাশিত: ০০:০৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২; আপডেট: ১০:৩৯, ১ সেপ্টেম্বর ২০২২

চা রফতানি কমছে, আমদানি বাড়ছে

চা রফতানি কমছে, আমদানি বাড়ছে

গত বছরের কথাখুব বেশি প্রচার না হলেও একটি রেকর্ড অর্জন করে দেশের চা শিল্প২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে রেকর্ড পরিমাণ মোট ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উপাদিত হয়েছে, যা ২০২০ সালের চেয়ে ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার কেজি বেশিসহজ করে বললে, গত বছর চায়ের উপাদন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে

উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকেও ২০২১ রেকর্ড পরিমাণ ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা জাতীয় উপাদনে যুক্ত হয়েছে, যার পরিমাণ ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি ছিলকিন্তু বার্ষিক ভোগের চেয়ে উপাদন বাড়লেও আমদানি এখনও কমেনিদেশের শীর্ষস্থানীয় চা বিপণন ও মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলো এখনও নিয়মিত চা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মেটাচ্ছেদেশে চা উপাদন বাড়লেও ভাল মানের চা উপাদনের পরিমাণ তুলনামূলক না বাড়ায় এখনও আমদানি নির্ভরতা কাটছে না বলে মনে করছে চা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো

একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে চা রফতানি কমছেএকাধিক চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, সিংহভাগ চা বাগান ভাল মানের চা উপাদন করে নাঅধিকাংশ বাগান কর্তৃপক্ষই গুণগত মানের চেয়ে চা উপাদনের পরিমাণকে প্রাধান্য দেয়

বাংলাদেশের চা বোর্ডের হিসেবে এ মুহূর্তে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান ও টি এস্টেট আছেতবে এর মধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১২৯টি বাগান ও টি এস্টেটব্যবসায়ীরা বলছেন, চা বাগান হতে গেলে ন্যূনতম ২৫ একর জমির বাগান লাগেঅন্যদিকে এস্টেট হলো চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ ও শ্রমিক কর্মচারীর মৌলিক সুযোগ-সুবিধাসহ চা বাগান

সব মিলিয়ে সে হিসেবে বাংলাদেশে ২ লাখ ৮০ হাজার একর জমির নিবন্ধিত বাগানে চা চাষ করা হচ্ছেচা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসেবে, সত্তরের দশকে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৭৩৫ কেজি চা উপাদন হতোসেই উপাদন বেড়ে এখন জমি ভেদে প্রতি একরে ১৫০০ থেকে ৩৫০০ কেজিতে দাঁড়িয়েছেদেশের উপাদিত চায়ের বড় অংশই এখন আসে মৌলভীবাজারের বাগানগুলো থেকেদেশের যত চা উপাদন হয় তার ৫৫ ভাগই আসে এই জেলার বাগানগুলো থেকেসিলেট অঞ্চলের বাইরে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে আসে উপাদিত চায়ের দশ ভাগ

মূলত ২০০১ সাল থেকেই দেশে ধারাবাহিকভাবে চা উপাদন বেড়েছেওই বছর উপাদন হয়েছিল ৫ কোটি ৩ লাখ কেজির মতো২০০৬ সালে দেশে সর্বনি¤œ ৫ কোটি ৩৪ লাখ কেজি চা উপাদন হয়পরবর্তী সময়ে চা উপাদন বেড়ে ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজিতে উন্নীত হয়এরপর ২০১৬ সালে উপাদন এক লাফে সাড়ে আট কোটি কেজিতে উন্নীত হয়এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে দেশে চা উপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার কেজি হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রেকর্ডকরোনাকালে ২০২০ সালে উপাদন কিছুটা কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজারে নামলেও সর্বশেষ ২০২১ সালে চা উপাদন উন্নীত হয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজিতে

সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের উপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ কোটি কেজিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে উত্তরবঙ্গের পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায় সমতলীয় জমিতে চা চাষ হচ্ছেকয়েক বছর ধরে উত্তরবঙ্গের সমতলের চা উপাদন ঈর্ষণীয়ভাবে বেড়েছে২০২০ সালে উত্তরাঞ্চলের সমতলীয় ক্ষুদ্র চাষীরা উপাদন করেছিলেন ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চাকিন্তু ২০২১ সালে সমতলে উপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা, যা দেশে সার্বিক চা উপাদনের ১৫ শতাংশের বেশিসাম্প্রতিক সময়ে রেকর্ড চা উপাদন হলেও চা বাগান শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে খুবই কম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থা ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকাচলতি সপ্তাহে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণের পর চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৫ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক আয় ৬১ হাজার ২০০ টাকা২০০৮ সালের পর গত ১৪ বছরে চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে সাড়ে ৮৭ টাকা২০০৮ সালে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত একজন চা শ্রমিকের সর্বোচ্চ মজুরি ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সাচা-বাগানসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে চা উপাদনে বাংলাদেশ নবম স্থানে ওঠে এসেছে

করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা উপাদনে সক্রিয় থাকায় চা উপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন স্থানে চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন বাংলাদেশের চেয়ে বেশিএছাড়া শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ শীর্ষ চা-উপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম

রেকর্ড উপাদন, তবুও চা আমদানি গত বছরের শুরুতেই দেশের শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানি চা আমদানির অনুমোদন নিয়েছে চা বোর্ড থেকেঅন্য কয়েকটি কোম্পানি চা আমদানির জন্য আবেদন করেছেমূলত চা উপাদন বাড়লেও ভাল মানের চা উপাদনে পিছিয়ে থাকায় দেশের চা খাত এখনও শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করেনিভাল মানের চায়ের জন্য বিদেশমুখিতার পাশাপাশি দেশে অবিক্রীত নি¤œমানের চা রফতানি করছে বাংলাদেশ

গত ৬ জানুয়ারি আবুল খায়ের গ্রুপ ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ কেজি চা আমদানির অনুমতি পেয়েছেছয়টি কনটেনারে করে অনুমোদন পাওয়া এসব ব্ল্যাক টি আমদানি হচ্ছে কেনিয়া থেকেপ্রতিষ্ঠানটি প্রতি কেজি ব্ল্যাক টি আমদানি করছে ২ দশমিক ৫০ ডলারেঅন্যদিকে একই দিন ইস্পাহানি গ্রুপ কেনিয়া থেকে তিন ধাপে মোট ২৮৮ টন চা আমদানির অনুমোদন পেয়েছেপ্রতি ধাপে ৯৬ হাজার কেজি চা আমদানিতে গ্রুপটি খরচ করছে ১ লাখ ২০ হাজার ৯৬০ ডলার করেঅর্থা একটি অনুমোদনে মোট তিন ধাপে ২ লাখ ৮৮ হাজার কেজি চা আমদানিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় চা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৮৮০ ডলারবছরের শুরুতে এ পরিমাণ আমদানি ছাড়াও আবেদনের অনুমতি পেলে চলতি বছরই বিপুল পরিমাণ চা আমদানি করবে শীর্ষ কোম্পানিগুলো

চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে চা আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার কেজি২০২০ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৭১ হাজার কেজি২০১৯ সালে ১৫ লাখ ২৫ হাজার কেজি২০১৮ সালে ৭৪ লাখ ৩৯ হাজার কেজি এবং ২০১৭ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ৮৭ লাখ ৩২ হাজার কেজিএকইভাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে শূন্য দশমিক ৬৮ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি হয়েছে

এর আগের বছর অর্থা ২০২০ সালে ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি হয়২০১৯ সালে রফতানির পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৬০ মিলিয়ন কেজিএর আগের দুই বছর ২০১৮ সালে শূন্য দশমিক ৬৫ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৭ সালে ২ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন কেজি চা রফতানি হয়

দেশে প্রথম সারির চা বাগানগুলো নিলামে প্রতি কেজি চা বিক্রি করছে গড়ে ২৬০-২৭০ টাকায়অথচ সারা দেশের বাগানগুলোর গড় চা বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ২০০ টাকারও কমেএছাড়া উত্তরবঙ্গের সমতলের চা বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকা গড় দরেমূলত দেশের প্রথম সারির দুই-তৃতীয়াংশ বাগানে চা উপাদন বেশি হলেও নি¤œমানের চা উপাদনই ভাল মানের চা উপাদনের বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন চাসংশ্লিষ্টরা

আমদানির বিষয়ে চা বোর্ডের উপপরিচালক (বাণিজ্য) মদহুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘এক সময় দেশে চা আমদানির পরিমাণ ছিল ৭০-৮০ লাখ কেজিবছর বছর উপাদন বৃদ্ধি পেয়ে আমদানির পরিমাণ এখন ১০ লাখের নিচে চলে আসছেপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আমরা মানসম্মত চা উপাদনেও নজর দিচ্ছি

দেশের শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্র্যান্ডেড কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, চা বোর্ড উপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলেও গুণগত মানের প্রশ্নে এখনও পিছিয়েযে কারণে চা আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের পরও জনপ্রিয় কোম্পানিগুলো চা আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছেদেশের উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ও রুগ্ন চা বাগান নি¤œমানের চা উপাদনের মাধ্যমে চায়ের পরিমাণ বাড়াচ্ছেআমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ভাল মানের চা উপাদনের ক্ষেত্রে চা বোর্ড কঠোর অবস্থানে না গেলে পরিমাণ বাড়লেও দেশের চায়ের মান বাড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা

চা রফতানিতে নজর নেই মালিকদের গত দুই দশকে চায়ের উপাদন বেড়েছে দেড়গুণেরও বেশিপক্ষান্তরে রফতানি কমেছে অর্ধেকের মতোচা বোর্ডের হিসেবে, ২০০১ সালে চা রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকামাঝে দু এক বছর কিছুটা বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০২১ সালে এসে রফতানি থেকে এসেছে ১৮ কোটি টাকা

বর্তমানে চীন, জাপান, পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ তেইশটি দেশে বাংলাদেশের চা যাচ্ছেব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে এখন উপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজির মতোকিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদাই আছে সাড়ে দশ কোটি কেজিরও বেশি, যা ক্রমশ বাড়ছেঅর্থা দেশেই প্রতি বছর চাহিদার তুলনায় ১ থেকে ২ কোটি কেজি চায়ের ঘাটতি থেকে যাচ্ছেমূলত এ কারণেই চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না

তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশে রফতানি বাড়াতে উপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশে জনপ্রিয় জাতগুলোর চায়ের উপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলছেটি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিটিএবি) চেয়ারম্যান ওমর হান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দুটি কারণে উপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি সত্ত্বেও রফতানি কমেছেএগুলো হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা উপাদন হারের মতোই বেড়ে যাওয়া আর বিশ্ববাজারের চেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেই ভাল দাম পাওয়াপাদন ব্যাপক বেড়েছেআর আমি যখন লোকাল বাজারেই ভাল দাম পাচ্ছি তাহলে আমি আন্তর্জাতিক বাজারে যাব কেন? এখানে সেটাই হচ্ছে

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মান ভাল হওয়ায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চায়ের চাহিদা রয়েছেতবে প্রত্যাশা মতো চা রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে নাপাদন বাড়লেও অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেশ ভালসরকার দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চা রফতানির পদক্ষেপ নিয়েছেআমরা সম্ভাবনাময় এই শিল্পের রফতানি বাজার ধরতে চাই

×