চা বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল
চা বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল। চা পান করা বাঙালীদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এই চা শিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন বছরে সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন কেজি। প্রায় ২৫টি দেশে রফতানি করা হয়। এ দেশের চা পৃথিবীব্যাপী সিলেট টি নামে খ্যাত। ৭০ শতকে উৎপাদিত চায়ের অধিকাংশই রফতানি করা হতো। তবে এখন দেশীয় বাজারেই চায়ের রয়েছে বিপুল চাহিদা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে দেশে নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগান থেকে রেকর্ড ৯ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। রফতানি হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার কেজি। বেশিরভাগ চা বাগান সিলেট ও মৌলভীবাজার অবস্থিত। অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এই শিল্পের অবদান ব্যাপক। কিন্তু বাঙালীর এই জনপ্রিয় পানীয় উৎপাদনকারী চাষীদের বঞ্চনা নিয়ে সম্প্রতি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে জানা যায় বর্তমান চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারেও একজন চা শ্রমিক আট ঘণ্টা কাজ করে পাচ্ছেন মাত্র ১২০ টাকা।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সন্তোষ রবিদাস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আমার জন্মের সময়ে মা দৈনিক ১৮ টাকা মজুরিতে কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি তখন মায়ের মজুরি হয় ৮৮ টাকা। ২০১৪ সালে ১০২ টাকা করে পেতেন।’ চলতি অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে তিন হাজার সাত মার্কিন ডলার। আর চা শ্রমিকদের ১২০ টাকা হিসেবে মাসিক আয় ৩ হাজার ৬০০ টাকা।
এ টাকা দিয়ে একটি মানুষের ক্ষুধার চাহিদা মেটানো কষ্টের সেখানে একটি সংসারের ব্যয়ভার কিভাবে বহন করছে! চা বাগানের মালিকরা বিপুল সম্পদের মালিক। এ কারণে হয়তো তারা ক্ষুধার যন্ত্রণা বোঝে না। চলতি মাসের ৯ তারিখ থেকে চাষীরা কর্মবিরতি ও ধর্মঘট করলে মালিকপক্ষ ২৫ টাকা বাড়াতে রাজি হলেও চাষীদের দাবি অনুযায়ী ৩০০ টাকা করার ব্যাপারে কোন মতামত জানা যায়নি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাগান মালিকদের সংগঠন চা সংসদ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল ২০২০ সালে। প্রায় দুই বছরেও সে চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। চা চাষীরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বাগান মালিক কর্র্তৃপক্ষ থেকে জানা যায়, ন্যায্য শ্রমমূল্যের দাবিতে মাত্র ৭ দিনের কর্মবিরতিকালে সিলেটের মৌলভীবাজারে ৬৪ লাখ ৭৪ হাজার কেজি পাতা গাছেই নষ্ট হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩১ কোটি টাকা। এমন অবস্থা দীর্ঘদিন থাকলে চা শিল্পে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবুও আট ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে ৩০০ টাকা মজুরি দিতে মালিক পক্ষের কঠোরতা বিস্ময়কর! ভোগ্যপণ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে অনেক হাত বদল হয়। ফলে চূড়ান্তমূল্য বাড়বে এটাই স্বাভাবিক তবে তার মাত্রা থাকা দরকার। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের নানারকম কারসাজিতে ভোক্তা এবং চাষীরা বরাবরই নিষ্পেষিত হয়।
বাংলাদেশে প্রতিবছর চায়ের উৎপাদন ৯ কোটি কেজি। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে দেশীয় বাজারে চায়ের চাহিদা বাড়ছে এবং চাহিদার সবটাই নিজস্ব উৎপাদন থেকে মেটানো হচ্ছে। উচ্চবিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত সবাই অতিথি আপ্যায়নে যত কিছুই রাখুক সঙ্গে থাকবে এক কাপ চা। একসময় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চাশিল্পের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় পাট ও তৈরি পোশাক শিল্প।
অর্থকরী ফসল চা দেশে প্রথম চাষাবাদ হয় ১৮৪০ সালে। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। কেননা চায়ের চারা রোপণ করে তিন বছর পরিচর্যার পরে পাতা সংগ্রহের উপযোগী হয়, তবে পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত যথাযথ পরিপূর্ণতা লাভ করে না। একটি চা গাছ ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত উৎপাদনের উপযোগী থাকে। এরপর পুনরায় নতুন গাছ রোপণ করতে হয়। চাইলেই চা শ্রমিক পরিবর্তন করা যায় না। এ কারণে যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকরা বংশানুক্রমিকভাবে চা চাষে নিযুক্ত রয়েছে। যুদ্ধোত্তর দেশের মাত্র দুটি জেলায় চা আবাদ করা হয়েছিল।
একটি সিলেট জেলায় ‘সুরমা ভ্যালি’ এবং অন্যটি চট্টগ্রাম জেলায় ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল যা বর্তমানে ‘চট্টগ্রাম ভ্যালি’ করা হয়েছে। এরপরে দেশের উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকায় চা চাষ করা হয়। চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, চলতি বছর দেশের ২৪১টি চা বাগান থেকে ৯ কোটি ৭০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০০০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ৯ম ছিল, ২০০৮ সালে ১১তম স্থানে নেমে আসে। তবে ২০১০ সালে চা উৎপাদন আবার বৃদ্ধি পায়।
চা শিল্পের বিকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৫৭-৫৮ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সে সময় দেশের চা শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি ‘টি এ্যাক্ট-১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন যা এখনও চালু রয়েছে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। উক্ত সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে। এছাড়াও তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন; যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে চা বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ চা বোর্ড ও শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চা শিল্পে প্রায় দেড় লাখ লোক কর্মরত আছে। আশার খবর হলো, গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চা বাগানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। এর মাধ্যমে বঞ্চিত চা শ্রমিকদের জন্য কোন সুখবর আসবে এটাই প্রত্যাশা।