ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

ধূসর শ্রাবণ মেঘে জ্বলেছিল তারা

পিযুষ কান্তি বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২১:০১, ৩১ জুলাই ২০২৫

ধূসর শ্রাবণ মেঘে জ্বলেছিল তারা

অনাকাক্সিক্ষত তাপের দহনে পুড়েছে প্রকৃতি গ্রীষ্মে

অনাকাক্সিক্ষত তাপের দহনে পুড়েছে প্রকৃতি গ্রীষ্মে। বিদীর্ণ-বিবর্ণ-নিসর্গে আষাঢ় ঢেলেছে জল। তৃষ্ণার্ত পৃথিবী আকণ্ঠ মগ্ন হয়েছে আষাঢ়ের নবধারাজলে। কিন্তু তারপর এক সময় অনিয়ন্ত্রিত চৈত্র-তাপনের মতো আষাঢ়ের ধারাজল জীবনঘাতী হয়ে ওঠে পৃথিবীর নিশ্বাসে। জলোৎসব এক সময় পরিণতি পায় জলদ-ে। যদিও কদম-কেয়ার রূপে নিসর্গ পেয়েছে সুখ কিছুটা কাল, তবুও কখনো একটানা বর্ষণ আর কখনো তীব্র তাপের দ্বৈরথে জীবকুল উভয় সংকটে।

এ সংকট মোচনে বুঝি শ্রাবণ এলো নিসর্গ-মঞ্চে। শ্রাবণের আবির্ভাবের জন্য আষাঢ়ের মঞ্চ তৈরি প্রায়। আষাঢ়ের মেঘে এখনো পাকেনি ধূসরতা। মেঘে মেঘে সবেমাত্র ভারি হয়েছে কাদম্বরীর আঁচল। আর দিন কয়েক পরে শ্রাবণের উৎসবে জলদ- জলহরষে পরিণতি পাবে। এখনো আষাঢ় থেকে থেকে গ্রীষ্মের উত্তাপকে জায়গা ছেড়ে দেয়। কিন্তু শ্রাবণ মেঘের দিন এলে উষ্ণতা নেতিয়ে যাবে আর্দ্র জলকণায়। আর তখনই বাজবে মাদল বাদ্য মেঘমেদুরে, মন খারাপ করা ধূসর বাজাবে তান ঝম ঝমা ঝম রুদ্র আবাহনে। 
‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে।’ কেঁপে উঠেছে নদী ও নিসর্গ, শ্রাবণ-মসীর প্লাবন-বাঁশিতে। আকাশখানা ধীরে ধীরে জল-রং তুলির প্রলেপে আঁকা ক্যানভাস হয়ে উঠেছে। কাদম্বরী মেঘের বিস্তার গেছে বেড়ে। কখনো দুপুরে সন্ধ্যা নামে, প্রভাতে প্রদোষ। ‘রাশি রাশি ভারা ভারা’ ধান খেতে নেমে আসবে আজ শ্রাবণের উছল ধারা। শান্ত নদীটিরে প্রাণবন্ত করে দানবীয় রূপ দিয়ে তারে ভরিয়ে তুলবে শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যায়। পরপারে তরুছায়া যেনো নিবিড় আঁধারে ঢাকা রহস্যের পট হয়ে রইবে।

রবীন্দ্র ভাষ্যে পাই, ‘বর্ষাকালে বিরহিনীর সমস্ত ‘আমি’ একত্র হয়, সমস্ত ‘আমি’ জাগিয়া উঠে।’ আর তাই এমন দিনে বিরহিনী কারে জানি মনের কথা খুলে বলতে চায়। বুকের মিষ্টি বেদনায় বিরহিনী চেয়ে থাকে প্রাণের পথিকের সনে। কিন্তু তার দৃষ্টি ঝাপসা করে শ্রাবণের অঝোর ধারা তার বিরহকে আরও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। শ্রাবণ-সন্ধ্যার বর্ষার আলাপনে মাতাল হয়ে ওঠে ভাবুক মন। মাঝে মাঝে তাই গীতলতা বেয়ে ওঠে স্মৃতির তরু বেয়ে- 

‘বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যা বেলা, কোন বলরামের আমি চেলা, আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে-যত মাতাল জুটে’। আষাঢ়ের অগোছালো ধারা বেয়ে শ্রাবণের শৃঙ্খলে প্রকৃতি বাঁধা পড়ে। হঠাৎ করে মনের বাউল গেয়ে উঠে- ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে।’ শ্রাবণের এই জড়ো হওয়া মেঘ সে কেবল বিরহ বা বেদনার বিবরণ নয়, এ যেনো বিনোদনেরও বিপুল বিথার। পুকুরের জলে টইটম্বুর করে যেন মহাসিন্ধু,  চৈত্রের শুকানো ডোবা নিমিষেই হয়ে যায় পদ্মপুকুর। খাল ভরে নদী হয় জলোৎসবে। উচ্ছ্বাসে জীবনানন্দ তখন মেতে ওঠেন-

‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি
মাছ রাঙাদের বললাম,
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় সে চলে গেছে মেয়ে।’
দূর সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়া নাবিকের মন-মাঝি শ্রাবণের মেঘদূতে সওয়ার হয়ে ছুটে আসে যেন একাকী বিরহিনী বঁধুয়ার মনে। বৃষ্টির জলদূতের কাছে বিরহিনী পত্র লেখে তার মনের কান্ত সমীপে-

‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে’

শ্রাবণের দাপট আছে, আছে রুদ্রতা। আছে ভয়ংকর সৌন্দর্যের আনন্দ-নটরাজ। শ্রাবণ-বন্দনায় কাজী নজরুল শিব-স্তোত্রে উদাত্ত ঝঙ্কারে বলেছেন-
‘গরজে গম্ভীর গগনে কম্বু।
নাচিছে সুন্দর নাচে স্বয়ংভূ
সে-নাচে হিল্লোলে জটা আবর্তনে
সাগর ছুটে আসে গগন-প্রাঙ্গণে।
আকাশে শূল হানি
শোনাও নব বাণী
তরাসে কাঁপে প্রাণী
প্রসীদ শম্ভু।’

শ্রাবণ আসে বজ্র-বিদ্যুতে। শ্রাবণ আসে বিজলী চমকে, মেঘের ধমকে। নিসর্গ তাই বুক পেতে রয় উদাত্ত হয়ে। এসো হে প্রিয় বলে শ্রাবণে আলিঙ্গন করে প্রকৃতি, ধরণী মায়ায় বাঁধে শ্রাবণ-শর্বরী। দাদুরের ডাকে ডাকে আঁধার প্রকৃতি হয় উতলা। বাতাসের শন্ শন্ শ্রাবণের বিজয় ডঙ্কা বাজায়। বাঁকবনের পাতাগুলো লক্ষ জিহ্বা হয়ে বাণীমুখর থাকে পবনে মাতাল হয়ে। শ্রাবণ ধরে তান- ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না শুনে’। 

আঁধারের তপস্যা ভাঙে শ্রাবণ-নির্ঝর। কবি হয়ে ওঠে কাব্যমুখরÑ
‘ললাট-শশি টলি জটায় পড়ে ঢলি
সে-শশী চমকে গো, বিজলি ওঠে ঝলি।
ঝাঁপে নীলাঞ্চলে মুখ দিগঙ্গনা
মূরছে ভয়ভীতা নিশি নিরঞ্জনা।
আঁধারে পথ হারা
চাতকী কেঁদে সারা
যাচিছে বারিধারা
ধরা নিরম্বু’

শ্রাবণ-বর্ষার রং-রূপ-রুদ্রদ্রোহে কবিগুরু আপ্লুত হয়ে বলেছেন, ‘আমি যখন বর্ষার গান গেয়েছি তখন সেই মেঘমল্লারে জগতের সমস্ত বর্ষার অশ্রু ধ্বনি নবতর ভাষা এবং অপূর্ব বেদনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে, চিত্রকরের চিত্র এবং কবির কাব্যে বিশ্বরহস্য নূতন রূপ এবং নূতন বেশ ধরে দেখা দিয়েছেÑ তার থেকেই জেনেছি এই জগতের জলস্থল-আকাশ হৃদয়ের তন্তু দিয়ে বোনা, নইলে আমার ভাষার সঙ্গে এর ভাষার কোনো যোগই থাকত না; গান মিথ্যা হত, কবিত্ব মিথ্যা হত, বিশ্বও যেমন বোবা হয়ে থাকত আমার হৃদয়কেও তেমনি বোবা করে রাখত।’

গ্রীষ্মের আগুনো মেঘ হতে মুক্তি পেয়ে আষাঢ়ের কদম-কায়াঝরা বৃষ্টির ধারা বেয়ে শ্রাবণ নামে ধূসর রূপের নহরে। ঝিঁঝিঁর কলতান আর বর্ষার বরুণধারায় শ্রাবণ মাতোয়ারা হয়ে ওঠে গ্রামীণ পরিসরে। নৌকা বেয়ে আঙ্গিনায় চলে আসে হাটুরের দল। কামরাঙ্গা জলে ভিজে রোমাঞ্চের সুর তোলে মনের লহরীতে। রাতের আকাশ ভরা ধূসর মেঘের কোণে হঠাৎ জ্বলে উওঠে তারা। যেন উঁকি দিয়ে দেখে যায় ধরণীর নীরমাখা, নীড়জাগা মানুষের মাতাল মুহূর্তকে। রাত জাগা কবির কণ্ঠে তখন বেজে ওঠে গান-

‘ধূসর শ্রাবণ মেঘে জ্বলেছিল তারা
আগুনের ফুলকি ছোটে বৃষ্টির জলকণা হতে
শ্রাবণী বাতাস বেয়ে লেলিহান শিখায়
উঠেছে জ্বলিয়া অতীত এক লহমায়।’

প্যানেল হু

×