ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

কর্মমুখর বাহাদুরপুর গ্রাম

বউ-শাশুড়ির ভালোবাসায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২২ জুন ২০২৫

বউ-শাশুড়ির ভালোবাসায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপট

.

গ্রামের নাম বাহাদুরপুর। একটা সময় সেই গ্রামে ঝগড়াঝাটি  লেগেই থাকত। সেখানে আজ ওই নারীদের দৃশ্যপট পুরোইটাই পাল্টে গেছে। অবাক করা কান্ড মনে হলেও বাস্তবতা তাই বলছে। তারা মিলেমিশে বিভিন্ন পোশাকে নকশা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন সংসারে। এখন কলহবিবাদের স্থান পরিণত হয়েছে কর্মমুখর গ্রামে। কয়েক বছর আগেও গ্রামটির অনেক পরিবারে আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। সেখানে দরিদ্র পরিবারের নারীরা আয়ের পথ খুঁজে পাওয়ায় সেই চিত্র এখন অনেকখানিই বদলে গেছে। আর এই সুযোগ করে দিয়েছেন ওই গ্রামের একটি পরিবারের বউ সাবিনা বেগম ও শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম। সাবিনা হলো মনোয়ারা বেগমের পুত্রবধূ।
আমরা সকলেই জানি আবহমানকাল থেকে মানুষে মানুষে চিরন্তন দ্বন্দ্বের মোক্ষম উদাহরণ বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক। এই জটিল সম্পর্ক নিয়ে রচিত হয়েছে কত না গল্প- উপন্যাস। উপমহাদেশে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় সিনেমা, নাটক ও টিভি সিরিয়াল। পত্রিকার পাতা খুললেও শাশুড়ির ইন্ধনে পুত্রবধূকে হত্যা কিংবা পুত্রবধূর অত্যাচারে শাশুড়ির মৃত্যুর খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। কোনো কোনো পুত্রবধূ শাশুড়িকে পাঠিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। বউ-শাশুড়ির সম্পর্ক একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়। এই সম্পর্কটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সহানুভূতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বাঞ্ছনীয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হতে পারে। কিন্তু বাহাদুরপুর গ্রামে এই বউ ও শাশুড়ি পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। যা অন্যদের কাছে শিক্ষনীয় হতে পারে।
রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক। মহাসড়কের ধারেই পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ। কাঁচা-পাকা সড়ক পেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার যেতে হয় রায়পুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। গ্রামের কৃষক ও কামলা ব্যস্ত কৃষি নিয়ে। অন্যদিকে সংসারের কাজ শেষ করে বসতবাড়ির উঠানে সুইসুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলার কাজে ব্যস্ত নারীরা। ওই নারীদের ঘিরেই বউ- শাশুড়ির সমাবেশ। কারও হাতে শাড়ি, কারও হাতে পাঞ্জাবি, কারও হাতে ফতুয়া, কারও হাতে থ্রি-পিস। সাধারণ একটি তৈরি পোশাকে সুই-সুতার সুনিপুণ কারুকাজে হয়ে উঠছে অসাধারণ। পুত্রবধূ সাবিনা বেগম তাদের কাজ শিখিয়ে দেন। আর শাশুড়ি করছেন সহযোগিতা।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে জীবনের গল্প শোনালেন পুত্রবধূ সাবিনা বেগম। রাজধানীর মিরপুরের মেয়ে তিনি। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় সাবিনা। এইচএসসি পাস করার পর ২০০৬ সালে এই গ্রামের মমিনুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পীরগঞ্জ বাজারে বইয়ের দোকান  মমিনুলের। এক সময় সংসারে সচ্ছলতা নিয়ে আসতে সাবিনা ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়াতেন। তিনি দেখতেন গ্রামের নারীদের ওপর অকারণে নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক কলহ যেন চলছেই। যা পরিবারে অশান্তি ডেকে আনছে। সাবিনা বিষয়টি নিয়ে তার শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে আলোচনা করেন। শাশুড়ির পরামর্শে ২০১৮ সালে সাবিনা পীরগঞ্জ পল্লী উন্নয়ন কার্যালয় থেকে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। সেই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর গ্রামে নারীদের মাঝে সাবিনা নিজেই শুরু করেন প্রশিক্ষণ। শাশুড়ির গাভী আর ছাগল বিক্রির ৮৫ হাজার টাকায় বাড়ির একটি কক্ষে পুরোদমে সেলাই ও হাতের কাজ শুরু করেন সাবিনা। ধীরে ধীরে কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ঢাকায় কয়েকটি কাপড়ের শোরুমের মালিকরা এসে বউ-শাশুড়ি ও গ্রামের নারীদের তৈরি পোশাকের নকশার কাজ দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। এরপর আর বউ-শাশুড়িকে পেছনে তাকাতে হয়নি। স্থানীয় এজেন্ট মনোনীত করে সাবিনার হাতে তুলে দেন শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস ও কাঁথায় নকশা করার সরঞ্জাম। মান ভালো হওয়ায় বাড়তে থাকে কাজের পরিমাণ।
গ্রামের ২৫ জন দরিদ্র নারীকে নিয়ে সাবিনা গঠন করেন বাহাদুরপুর ব্যাপারীপাড়া কুটিরশিল্প সমিতি। তিনি সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশা ও কারচুপির কাজ দেন। সমিতির বাইরে থাকা গ্রামের গৃহবধূরাও তার কাছে ছুটে আসেন কাজ শিখতে। সাবিনা তাদেরও প্রশিক্ষণ দেন। বর্তমানে এসব গৃহবধূ দুই শতাধিকে পৌঁছেছে। এই আয়ের টাকায় আবাদি জমি ও পাকা বাড়ি করেছেন সাবিনা। কিনেছেন মোটরসাইকেল, হাঁস-মুরগি ও গাভী। গাছপালায় ঘেরা বাড়িতে দুই ছেলে-মেয়ে, স্বামী ও শাশুড়িকে নিয়ে সুখের সংসার তার। সাবিনা বেগমের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর সুই-সুতার কাজ করে এলাকার অনেক নারী এখন স্বাবলম্বী। তাদের কেউ মাসে পাঁচ হাজার, আবার কেউ ৯ হাজার টাকা আয় করছেন। হাফিজা খাতুন (২৭) তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। আগে ভূমিহীন স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। এখন তার আয়ে সংসার চলছে, স্বামীর আয় জমা থাকছে। ৯ শতক জমি কিনেছেন। খড়ের ঘরের জায়াগায় তুলেছেন টিনের ঘর। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলও পালেন। কৃষিকাজ করে ছয় সদস্যের সংসার চালাতে কঠিন লড়াই করতে হতো গ্রামের মিজানুর রহমানকে। এখন তার দুই মেয়ে শিল্পী খাতুন ও তামান্না আক্তার নকশার কাজ করে নিজেদের পড়ার খরচ চালিয়েও প্রতি মাসে দুই-তিন হাজার টাকা জোগান দেয় সংসারে।  গ্রামের বাসিন্দা সানজিদা বেগম জানান, তিন বছর আগে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যান। সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে সাবিনা তাকে নকশা তোলার প্রশিক্ষণ দেন। এখন মাসে তার আট হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা সদস্য ববিতা বেগম বলেন, বাহাদুরপুর গ্রামে আগে কলহবিবাদ লেগেই ছিল। নারীরাও সব সময় ঝগড়া করতেন। এখন তারা মিলেমিশে নকশা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন। এ অবদান সাবিনা ও তার শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমের। তাদের হাত ধরে নারীরা যেভাবে আয় করার পথ খুঁজে পেয়েছেন, অন্য এলাকার নারীরাও তাদের দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কারণে কাজ করা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন সাবিনা বেগম। স্বামীর উৎসাহ আর শাশুড়ির ভালোবাসা ও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে সাবিনা বলেন, এখন আমার একটিই স্বপ্ন নারীদের জীবনে দুঃখ মোচন করা। এ জন্য পীরগঞ্জ সদরে বড় একটি পোশাক কারখানা করব। পুরো উপজেলার নারীদের সংগঠিত করে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা দেব। তারা সংসারে খরচ জোগাতে অবদান রাখবেন।
শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম বলেন, বউ-শাশুড়ির স¤পর্ক হতে হয় মা-মেয়ের মতো। একজন আদর্শ বউ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের মা-বাবার মতো সম্মান দিয়ে থাকে। মনেপ্রাণে ভালোবাসার নজির পেশ করেই আদর্শ বউ হতে হয়। অনুরূপ শ্বশুর-শাশুড়িকেও পুত্রবধূর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হয়। নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসার বন্ধনে আগলে রাখতে হয়। ছেলের বউ, শ্বশুর-শাশুড়ির কল্যাণেই স্বামীর হাত ধরে নতুন ঠিকানায় আসে। এ নতুন ঠিকানাকে জান্নাতময় করতে হলে বউ-শাশুড়ির মাঝে সমঝোতা জরুরি। তিনি বলেন, কুটিরশিল্পের ১৬ ধরনের কাজে পটু আমার পুত্রবধূ সাবিনা। পরিশ্রম করে শুধু নিজের ভাগ্য বদল করেননি, গ্রামের অনেক দরিদ্র নারীকে নকশার কাজ শিখিয়ে আর্থিক উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন। তার সহায়তায় সুই-সুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা তুলে ২০০ নারী দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। সংসারে এনেছেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। প্রায় প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে সাবিনা বেরিয়ে পড়েন। কাজ নিয়ে ছুটে চলেন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাড়িতে ফেরেন। সেখানে হাতের কাজ শেখান দরিদ্র নারীদের।
পীরগঞ্জ উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, দরিদ্র নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন বউ-শাশুড়ি।  প্রশিক্ষণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণও দেওয়া হয়েছে। তারা নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন তেমনি  অন্যদেরও এগিয়ে নিচ্ছেন । সৃষ্টি হচ্ছে সম্ভবনার নতুন দিগন্ত।

প্যানেল

×