
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা এলাকায় পাথর ভাঙা কাজ করছেন প্রান্তিক নারীরা
‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
কখনো নদীর মত, তোমার পথের পানে বয়ে বয়ে যায়...।’ বরেণ্য সংগীতশিল্পী প্রয়াত সুবীর নন্দীর কণ্ঠে জনপ্রিয় এই গানটি নারী পাথর শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট জীবনের সঙ্গে যেন এক হয়ে মিলে আছে। সেই সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে সংসার সামাল দিয়ে ছুটে যেতে হয় পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার কাজে। বিনোদন নেই জীবনে। গান-বাজনা শোনার সময়ও নেই। পেটের টানে স্বামীর সংসারে এসেও ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে এই গৃহবধূদের। যাদের স্বামী মারা গেছে বা বিচ্ছেদ ঘটেছে এমন নারীর সংখ্যা বেশি এই পাথর ভাঙা শ্রমে। পাথর ভাঙার ধুলো-ময়লা যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছেয়ে যায়। অনেকে অসুুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও থেমে থাকে না জীবন নামের রেলগািড়টা।
দেশের উত্তরের প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা ও ভোজনপুর। হাজারো নারী পাথর শ্রমিক ¯্রফে বাঁচার তাগিদে বেছে নিয়েছেন এই কঠিন শ্রমের কাজ।। কিন্তু মজুরির বেলায় নিগৃহীত হচ্ছেন তারা। কর্মসংস্থানে পাথর ভাঙার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকেন এই প্রান্তিক নারীরা। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত তারা। তবুও কাজ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। বাংলাবান্ধা ও মহানন্দা নদী থেকে উত্তোলন করা পাথরের সাইটে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক পাথর ভাঙার কাজ করেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই কাজ করে একজন মজুরি পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। পুরুষরা পান ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
পাথর ভাঙা শ্রমিক আমেনা বেগম (৪০) বলেন, স্বামীর অভাবের সংসার। একাই কাজ করে কুলাতে পারেন না তিনি। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। ছেলে- মেয়ে সংসার সামলানো কঠিন। বাধ্য হয়ে স্বামীর সংসারে জোগান দিতে আমিও ৬ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজে নেমে পড়ি। এর আগে সবারই মজুরি কম ছিল। তখনো আমাদের নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি।
মরিয়ম বেগম (৪৫)। দুই ছেলে সন্তান রয়েছে তার। তাদের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন তিনি। স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছিল। কিন্তু একদিন সংসারের ঝগড়ায় স্বামী তার ওই স্ত্রীকে খুন করেছিল। স্বামীর সাজা হয়েছে ৩২ বছর। দশ বছর হয় সাজা খাটছে। তাই বাধ্য হয়ে পাথর ভাঙা কাজে নামতে হয়েছে আমাকে। আগে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ টাকা পেতাম এখন ৫০০ টাকা পাই। এ দিয়ে সংসার খরচ চলে। এই নারী জানালেন, আমদের জীবনটা রেলগাড়ির মতো। সুখ কপালে নেই বলে আজও স্টেশন খুঁজে পাইনি। তাই সব সহ্য করে হাড়ভাঙা খাটুনির পাথর ভাঙা কাজে নেমেছি। মরিয়ম বেগমের কথা শুনে মনে হলো তিনি মিতালী মুখার্জির গাওয়া ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা পায় না খুঁজে ইস্টিশন, কোথা থেকে ছেড়ে এলো -যেতে হবে কতদূর- কোনখানে তার শেষ ঠিকানা কোনখানে তার অচিনপুর..’ এই গানটিকে ইঙ্গিত করে নিজের কষ্টের কথাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
ওই এলাকার পাথর ভাঙা শ্রমিক রেহানা বেগম বলেন, আমি ৯ বছর ধরে পাথর ভাঙার কাজ করছি। ২ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে সংসারে। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৭ বছর হলো। এক মেয়েকে কোনোরকমে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি লেখাপড়া করছে। অভাবের সংসারের চাহিদা মেটাতে অল্প মজুরি দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হয়। তিনি আরও বলেন, আগে সবারই মজুরি কম ছিল। তখনো নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরির পার্থক্য ছিল। এখন মজুরি কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু আমরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করেও মজুরি কম পাচ্ছি। তিনি জানান, পাথরের কাজ খুবই কষ্টের। প্রতিদিন এক লিটার করে দুধ খেতে হয়। বাজারে এক লিটার দুধের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা। জীবন বাঁচাতে এ পথ ছাড়তেও পারছি না। স্বামী নেই। সন্তানদের কথা চিন্তা করে জীবনের রঙ্গিন স্বপ্নগুলো যেন ম্লান । পাথর শ্রমিক রেহেনার কথাগুলো শুনে মনে হবে নিশ্চিয়ই সুবীর নন্দীর ওই গানের আরও কথায়-‘শুনিতে চাই না গান, তবু সুর ফিরে আসে, স্বপ্নের বাঁশি বাজে, জীবনের বারো মাসে কত রাত্রিতে আমার প্রদীপ শুধু জ্বলে জ্বলে যায়।’
দ্রব্যে মূল্য ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় সংসারের যোগান দিতে দিন দিন নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংসারের চাহিদা ও ভরণ-পোষণের জন্য ঘরের কাজ সেরে জীবিকার তাগিদে নারীরা নেমে পড়েন মাঠে-ঘাটে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ঘরে-বাইরে প্রায়শ নিগৃহীত হচ্ছেন তারা।
তাদের কষ্টের কথা বুকে চেপে ধরে রাখেন। তবে পাথর সংশ্লিষ্ট কাজে কম মজুরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে জানিয়েছেন নারী শ্রমিকরা। এ অঞ্চলের নারী শ্রমিকরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন। এতে সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। এক সময় নারীরা শুধুই ঘর- গৃহস্থালির কাজ করতেন। সরেজমিনে গিয়ে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনের অনেক কথাই উঠে আসে। বিশেষ করে তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত থেকে বয়ে আসা ১৭ কি.মি. মহানন্দা নদীর বিভিন্ন পাথর সাইটে কাজ করেন কয়েক হাজার নারী শ্রমিক। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে মজুরি পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
পাথর ভাঙার কাজে নিয়োজিত ফিরোজা নামে নারী শ্রমিক জানালেন, আমরা পাথর ভাঙার মেশিনে কাজ করছি। সারাদিন সমান কাজ করেও আমাদের মজুরি পড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আর পুরুষদের মজুরি ৭০০ টাকা ৮০০ টাকা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর এলাকায় একেকজন পুরুষ পাথর শ্রমিক পাথর ভাঙা মেশিনে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে কেউ ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন বলে জানালেন পাথর ব্যবসায়ী ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, মহানন্দা নদীর পাথর কমে যাওয়ায় পাথর ভাঙার কাজ কোনোরকমে চলছে। উপায় নেই, কারণ পুরুষরা যে কাজটি খুব তাড়াতাড়ি করতে পারে সেই তুলনায় নারীরা ওই কাজ বেশি সময় নিয়ে করে। পুরুষ শ্রমিকরা বেশি পরিশ্রম করে থাকে। বর্তমানে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী পাথর শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়া হয়ে থাকে।
অপর পাথর ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, আগে তো নারী শ্রমিকরা পাথর ভাঙার কাজে আসত না। দিন দিন নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। । তবে প্রান্তিক পর্যায়ে পাথর ভাঙা মেশিনের সাইটগুলোতে নারী শ্রমিক সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরুষ শ্রমিকরা ভারি কাজগুলো করে, তাই তাদের বেতন বেশি। কিন্তু নারী শ্রমিকরা শুধু দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করেন। সে হিসেবে মজুরি দেওয়ার সময় নারীদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়। আমরা চাই এই ধরনের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক।
পঞ্চগড়ের দুপ্রকের সদস্য সহিদুল ইসলাম সহীদ বলেন, পাথর শিল্পে নারী-পুরুষের মধ্যে আমরা একটা প্রার্থক্য লক্ষ্য করি। পুরুষ শ্রমিকরা যে মজুরি পেয়ে থাকেন নারী শ্রমিকরা তার থেকে মজুরি কম পেয়ে থাকেন। আমি মনে করি এ ধরনের প্রার্থক্য থাকা উচিত না। কারণ একজন নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের মতোই সমানভাবে কাজ করেন। তাহলে সমান মজুরি পাওয়ার হক তাদেরও। আমি বিশ্বাস করি আমাদের পাথর সংশ্লিষ্ট ক্রাশিং মালিকরা রয়েছেন, তারা এই বৈষম্য কমাবেন এবং মজুরি সমান রাখবেন।
পাথর ভাঙার মতো কঠিন কাজে নারী শ্রমিকরা ভীষণরকম বঞ্চনার শিকার এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। জীবন নামের রেলগাড়িটা কবে স্টেশন খুঁজে পায় সেই আশায় প্রহর গুনছে তারা।
প্যানেল