ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঠাকুরগাঁও: ঐতিহ্যের এক রঙিন ক্যানভাস

আব্দুন নুর আজাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঠাকুরগাঁও

প্রকাশিত: ১০:১৫, ২৪ মে ২০২৫

ঠাকুরগাঁও: ঐতিহ্যের এক রঙিন ক্যানভাস

ছবি: জনকন্ঠ

ঠাকুরগাঁও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষা এক শান্ত মফস্বল জেলা। বাহ্যিকভাবে নিঃশব্দ, তবে ভেতরে ভেতরে বহমান এক জীবন্ত ঐতিহ্যসংস্কৃতির, লোকজ ঐভবের, আর মানুষের গল্পে ভরা শত বছরের প্রবাহ। এ জেলায় শুধু ধানের মাঠ নয়, আছে সুরের স্রোত, বাঁশির ধ্বনি, ঢোলের তালে মুখরিত মেলা, আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলা লোকজ শিল্প।

সুরে সুরে বেঁচে থাকা ঠাকুরগাঁওয়ে পাহাড় নেই, নদীও সীমিত। তবুও এ জেলার মানুষের জীবনে সুরের অভাব নেই। প্রতিটি গ্রামের উঠোনে, খড়ের গাদার পাশে কিংবা হাটের কোণে গমগম করে ওঠে বাউল সুর

মন রে কইতাম তোমার লগে, কেমনে যে থাকি রে...”

এই জেলার বুকে আজও বেঁচে আছে পালাগান, মারফতি গান, ভাটিয়ালী আর বাউল সংগীত। ঠাকুরগাঁওয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল শুধু শিল্প নয়, এটি জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।

শীত নামলেই শুরু হয় যাত্রার মৌসুম। এখনো বহু গ্রামে বাঁশের মাচা বসে, তাতে আলোকসজ্জা, ঢাক-ঢোল, আর রঙিন মুখোশ। শিশুরা মুগ্ধ হয়ে দেখে, প্রাপ্তবয়স্করা ফিরে যায় শৈশবের স্মৃতিতে।

গড়েয়া মেলা, রাণীশংকৈল পৌষ সংক্রান্তি, কিংবা বালিয়াডাঙ্গীর নবান্ন উৎসবএসব যেন শুধু বাজার নয়, জীবন্ত সাংস্কৃতিক জাদুঘর। হস্তশিল্প, স্থানীয় খাবার, লোকনৃত্য, পুতুলনাচসব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত আনন্দঘন আবহ।

অজপাড়া গাঁয়ে এখনো নারীরা হাতে বানান পাটের ব্যাগ, খড়ের ঝুড়ি, কাঁথা, এমনকি নকশীকাঁথা। এইসব পণ্যে ফুটে ওঠে ঠাকুরগাঁওয়ের নিঃশব্দ শিল্পভাষা। অনেক পরিবার আজও এই হস্তশিল্পের ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করছে।

একই গ্রামে পাশপাশি বসবাস মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টানদের। ঈদ কিংবা দুর্গাপূজাসব উৎসবেই চলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি। ধর্মীয় উৎসব এখানে শুধুই ধর্মীয় নয়, সামাজিক মিলনের অন্যতম উপলক্ষও।

ঠাকুরগাঁও থিয়েটার, ‘উত্তরণ শিল্পীগোষ্ঠী, কিংবা স্কুল-কলেজের নাট্যদলগুলো ছোটদের শেখাচ্ছে সংস্কৃতির মানে। তাদের অনুশীলনে, কবিতা পাঠে, মঞ্চে উঠে দাঁড়ানোর সাহসে বাঁচে জেলার আগামী দিনের সংস্কৃতিচর্চা।

ঠাকুরগাঁও আজও তার শেকড় ছাড়েনি। আধুনিক প্রযুক্তি আর শহরায়ণের ঢেউ এসেও তার মাটির গন্ধ মুছে ফেলতে পারেনি। এখানকার মানুষ জানে, কেবল আগামীর দিকে তাকিয়ে চললেই হবে নানিজস্ব অতীতকেও ধারণ করতে হয় গর্ব নিয়ে।

ঠাকুরগাঁও একটি জেলা নয় শুধুএটি এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক কবিতা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে ইতিহাস, অনুভূতি আর মানুষের মুখচ্ছবি।

মুমু

×