ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

স্বাধীন মুসলিম শাসিত রাষ্ট্র বাংলা সালতানাতের ইতিকথা

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ২২:০২, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২২:০৪, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বাধীন মুসলিম শাসিত রাষ্ট্র বাংলা সালতানাতের ইতিকথা

ছবি: সংগৃহীত

শাহি বাংলা বা সুলতানি বাংলা নামেও পরিচিত 'বাংলা সালতানাত' ১৩৫২ সাল থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন মুসলিম শাসিত রাষ্ট্র।

এটি মধ্যযুগীয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপে অবস্থিত এই সালতানাত রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং স্থাপত্য কীর্তির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

সালতানাতের সীমানা তখনকার সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, সিক্কিম, মিজোরামের অংশ, মিয়ানমারের আরাকান এবং নেপালের মেচী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসক। ১৩৫২ সালে তিনি দিল্লি সালতানাতের অধিকার থেকে বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা করেন এবং তার শাসনামলে বাংলার ভূখণ্ড বিহার থেকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

গৌড় ছিল সালতানাতের প্রথম রাজধানী, যা মধ্যযুগে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। গৌড় ছাড়াও সোনারগাঁও, সাতগাঁও এবং পান্ডুয়ার মতো শহরগুলি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

বাংলা সালতানাতের সামরিক বাহিনী ছিল দক্ষ এবং সুসংগঠিত। এর শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশী রাজ্য এবং শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ করে নিজেদের সীমানা সম্প্রসারিত করেন।

শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ এবং তার উত্তরসূরিরা দিল্লি সালতানাত, ওড়িশার গজপতি রাজা এবং ত্রিপুরার স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে লড়াই করেন। তাদের সামরিক দক্ষতা বাংলাকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সাহায্য করে।

বাংলা সালতানাতের অর্থনীতি ছিল সমৃদ্ধ এবং বহুমুখী। কৃষি এই অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল। ধান চাষের পাশাপাশি পাট, চিনি এবং মসলা উৎপাদনে অঞ্চলটি খ্যাতি অর্জন করে।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় শহরগুলি যেমন চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে। চীন, আরব বিশ্ব এবং আফ্রিকার সঙ্গে এই অঞ্চলের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

সালতানাতের শাসকেরা টাকশাল স্থাপন করে নিজস্ব মুদ্রা চালু করেন, যা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল বাংলা সালতানাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যদিও মুসলিম শাসকেরা ইসলামী ধ্যানধারণা প্রচারের জন্য সচেষ্ট ছিলেন, তারা হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সহনশীল ছিলেন।

এই নীতির ফলে সমাজে একটি বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। স্থাপত্য ও শিল্পকলায় এই বৈচিত্র্যের প্রভাব দেখা যায়। ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর সমাধি এবং আদিনাথ মন্দিরের মতো নিদর্শনগুলো এই সময়কার স্থাপত্যের বৈচিত্র্য এবং শৈল্পিক উৎকর্ষের উদাহরণ।

সালতানাতের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য নতুন প্রাণ পায়। ফারসি ছিল রাষ্ট্রীয় ভাষা হলেও বাংলা ভাষা প্রশাসনিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় ফারসি ও বাংলা সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটে এবং সাহিত্যে আধ্যাত্মিকতা, প্রেম এবং বীরত্বের গল্পের প্রবাহ তৈরি হয়।

বাংলা সালতানাতের শাসকরা কেবল সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমেই নয়, বরং স্থাপত্যের মাধ্যমেও তাদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। টেরাকোটা শিল্প এবং ইসলামি স্থাপত্যের মিশ্রণে নির্মিত গৌড় ও পান্ডুয়ার মসজিদগুলো আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ এই সময়ের অনেক স্থাপনা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

১৫৪০-এর দশকে সুরি সাম্রাজ্যের আক্রমণে বাংলা সালতানাত দুর্বল হয়ে পড়ে। শের শাহ সুরির সামরিক শক্তির কাছে হার মানার পর সালতানাত ভাঙনের মুখে পড়ে।

অবশেষে ১৫৭৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে এই অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সুবা বাংলার অংশে পরিণত হয়।

বাংলা সালতানাত ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়, যেখানে সামরিক সাফল্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে এক স্বর্ণযুগের উন্মেষ ঘটেছিল।

এম.কে.

×