ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে রৌমারীর সেই টিনশেডের ডাকঘর
বহুকাল আগের কথা। ডাক হরকরা রানার কবিতাটা যারাই পড়েছেন হয়তো তারা আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন, যা হয়তো এখনো মনে বাজে। ভারতের প্রথম ডাকঘর খেজুরি বন্দর থেকে বাংলাদেশের রৌমারীর ডাকঘর ঘিরে রয়েছে অনেক অজানা কথা। রৌমারীর সেই বাঁশের চাটি আর টিনশেডের ডাকঘরটির ওপরে কাঁচ দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করার নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। অচিরেই সংরক্ষণের কাজ শুরু হবে।
‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে-রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে’... সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার কবিতাটি বলে দেয় বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে ডাক প্রথা অনেক পুরনো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ডাক প্রথার উল্লেখ আছে। স্বাধীনতার পর থেকে নব্বই দশকের শেষ দিকেও ডাক বিভাগের ব্যবস্থার যেন কোনো কমতি ছিল না। সে সময় বনশ্রী সেনগুপ্ত এর কণ্ঠে ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম- রঙিন খামে যত্নে লেখা আমারই নাম’ গানটি প্রচ-ভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ তো বটেই, এক সময়ে টেলিফোনও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রিয়জনের খবর পাওয়ার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হতো ডাকঘরের উপরেই। ডাকঘরে আসা ইনল্যান্ড লেটার, পোস্টকার্ড সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দিতেন রানাররা। কেমন ছিল তখনকার ডাকঘরের ভবনটি, রানারদের পোশাক? কেমন ছিল তাদের সঙ্গে থাকা লণ্ঠন? রানারদের সঙ্গে থাকা এসব সামগ্রী, তখনকার দিনের ডাক পিয়নের বেল্ট, ব্যাজ দেখার ইচ্ছে কার না করে।
উত্তরাঞ্চলের তৎকালীন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার রৌমারী সদর ইউনিয়নের বাজারপাড়া এলাকায় অবস্থিত বাঁশের চাটাই টিনশেড ঘরের সেই ডাকঘরটি আজ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এ অঞ্চলের ডাক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালে ডাক জাদুঘর স্থাপন করে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার জিপিওতে ক্ষুদ্র পরিসরে এ জাদুঘরটি যাত্রা শুরু করেছিল। পরবর্তী সময়ে ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত চেষ্টায় জাদুঘরটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ঢাকার জিপিও-সংলগ্ন ডাক অধিদপ্তরের তৃতীয় তলায় পশ্চিম পাশে ২ হাজার ১৬০ বর্গফুট আয়তনের জায়গা নিয়ে জাদুঘরটি। ডাক জাদুঘরে দেখা যাবে ডাক বিষয়ক বেশ কিছু দুর্লভ-দর্শনীয় বস্তু।
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে ডাক প্রথা অনেক পুরনো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ডাক প্রথার উল্লেখ আছে। ভারতের ইতিহাসে সম্রাট শের শাহকে তার ঘোড়ার ডাক পরিবহনের জন্য স্মরণ করা হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানির আগেও ডাচ, পর্তুগিজ ও ফ্রান্স বেনিয়ারা তাদের অধিকৃত এলাকায় ডাক চালু করেছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে, কলকাতা ও মাদ্রাজে ডাক ব্যবস্থা চালু করেছিল। লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৭ সালে কলকাতায় পোস্ট অফিস ও পোস্টমাস্টার নিয়োগ করেন। ১৭৭৪ সালে লর্ড হেস্টিংস ডাক ব্যবস্থাকে আরও জোরালো করেন। এভাবে বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষে একটি পুরনো ও শক্তিশালী সরকারি দপ্তর ও সেবা হিসেবে ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের আধুনিক ডাক বিভাগ ব্রিটিশদের আদল ও ঐতিহ্যে গড়া। ব্রিটিশ ভূখ-ে ১৫১৬ সালে ডাক চালু হয়। ১৮৫২ সালে চিঠি সংগ্রহের জনবান্ধব ব্যবস্থা হিসেবে লাল ডাকবাক্স বসানো হয়। ৫০০ বছরের রয়্যাল ব্রিটিশ ডাক বিভাগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে ডাক ও পার্সেল ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। কিন্তু সেবা কাঠামো সর্বজনীন ও ব্যয়সাশ্রয়ী আছে। প্রথম শ্রেণির ডাকে যে চিঠি ও দলিলপত্র পাঠানো হয়, তা পরদিন ১২টার মধ্যে প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছায়। পার্সেলের ক্ষেত্রেও একটি সময় রক্ষা করা হয়। চিঠি, ডকুমেন্ট ও পার্সেল প্রাপকের দোরগোড়ায় বিলি হয়।
১৭৭২ সালে খবর আদান-প্রদানের জন্য ভারতের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী অঞ্চল খেজুরি বন্দর সংলগ্ন এলাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি ডাকঘর গড়ে তোলে। যা ভারতের প্রথম ডাকঘর। এখনো রয়েছে তার ধ্বংসাবশেষ।
এই উপকূলবর্তী অঞ্চল অনেক গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে বহুকাল থেকে। সালটা ১৭৫৭ পলাশীর প্রান্তরে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হয়। ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কো¤পানি রাতারাতি বণিকের মানদ- রাজদ-ে পরিণত হয়। খেজুরের ইতিহাস কয়েকশ’ বছরের পুরনো। খেজুরিতে ডাচ ওলন্দাজ ও পর্তুগিজ বণিকেরা বহু সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছিল। খেজুরি সংলগ্ন হিজলিতে ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ নাবিকদের জাহাজ এসে পৌঁছায়। ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন জেমস মেরিনার নেতৃত্বে রেবেকা নামক একটি পালতোলা জাহাজ খেজুরি বন্দরে আসে। তৎকালীন খেজুরির নাম ছিল কেডিগিরি। সেই থেকে শুরু হয় খেজুরি বন্দর। এরও প্রায় একশ’ বছর পর ইংরেজরা ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে খেজুরি বন্দর গড়ে তোলে। মূলত লবণ, নীল ও দাসপ্রথার জন্য মানুষ কেনা বেচার ক্ষেত্র হিসেবে দ্রুতই খেজুরি বন্দরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। খেজুরিতে ডাকঘর আরও কয়েক বছর পরে চালু হয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বণিকদের ইন্ডিয়া কো¤পানির খবর আদান প্রদানের জন্য খেজুরিতে প্রথম ডাকঘর স্থাপন হয়। যা ভারতের প্রথম ডাকঘর। শুধু তাই নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৪২ ও ১৮৪৫ সালে খেজুরি বন্দর দিয়েই বিদেশ যাত্রা করেছিলেন। এ ছাড়াও বহু স্বাধীনতা সংগ্রামে খেজুরির ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে... শুনলেই মনে পড়ে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের এই প্রাচীন শহর কুড়িগ্রাম। গাড়িয়াল ভাইয়ের গানটির জন্ম ১৯৪৬ সালে। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদের কণ্ঠের এই গানটি আজও শীর্ষস্থান ধরে রয়েছে। ঠিক এই গানটির মতো কুড়িগ্রামের রৌমারীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে একটি ডাকঘরের পুরনো ঘরটি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তের পর রংপুর জেলার অধীন রৌমারী শাখার ডাকঘরটি স্থাপিত হয়। ২৮ মে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে রৌমারী শাখার পোস্ট অফিসটি সাব পোস্ট অফিসে উত্তীর্ণ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে হানাদার মুক্ত রৌমারীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থার অংশ হিসেব রৌমারী সাব পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চালু করা হয়। ওহিদ মাসুদ সাব পোস্ট মাস্টার হিসেবে, শাহ আব্দুল করিম, ডাক পিয়ন এবং মাদার বক্স রানার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পোস্ট অফিসের পোস্ট বক্স বিভিন্ন সিলমোহর ও অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রী সংরক্ষিত আছে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিদর্শন হিসেবে ঐতিহাসিক পোস্ট অফিসটি আজও রৌমারীর বুকে মাথা তুলে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন রৌমারী সাব-পোস্ট অফিসের রাজীবপুর, যাদুরচর, টাপুরচর, দাঁতভাঙা, শৌলমারী ও গেন্দার আলগা শাখা পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চলছিল। ১৯৮৪ সালের ৪ জুন পর্যন্ত রৌমারী সাব-পোস্ট অফিসটির কার্যক্রম টিনশেড ঘরটিতে চালু ছিল। সে বছর ৫ জুন রৌমারী সাব-পোস্ট অফিসটি উপজেলা পোস্ট অফিসে উন্নীত হলে এটির কার্যক্রম নতুন ভবনে শুরু করা হয়। টিনশেড ঘরের ডাকঘরটির পাশে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ভবন।
১৯৭১ সালে রৌমারী সিজি জামান হাই স্কুল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা কার্যক্রম ও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অন্যতম সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যা¤প। ওই সময়ে এ ক্যা¤প থেকেই প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রৌমারী সিজি জামান হাইস্কুলকে ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যা¤প হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এই ক্যা¤েপ সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী অনেক মুক্তিযোদ্ধা রৌমারী সাব পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বাড়িতে চিঠিপত্র পাঠাতেন। স্থানীয় বাসিন্দা কোব্বাস আলী চিশতী (৭০) বলে, বাংলাদেশের প্রথম ডাকঘরের ঘরটির প্রায় ২ ফুট অংশ মাটির নিচে দেবে গেছে। ‘১৯৭১ সালে এই ডাকঘরটি জাঁকজমক ছিল। এখানে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসতেন চিঠি পোস্ট করার জন্য। ডাকঘরটি রক্ষা করে ঐতিহাসিক পুরনো জিনিসপত্র ও ডকুমেন্ট দর্শনার্থীদের দেখার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন মরহুম শাহ আব্দুল করিমের কনিষ্ঠ পুত্র শাহ আব্দুল মোমেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত মুক্তাঞ্চলের ছোট টিনশেড ডাকঘরটির স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট রৌমারীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তুলে ধরার দাবি জানান। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আব্দুল কাদের সরকার বলেন, মুক্তিযদ্ধের মুক্তাঞ্চল রৌমারীর ইতিহাস সংরক্ষণের অভাবে একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির চিহ্ন। এখনো যে স্মৃতি চিহ্নগুলো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে তা সংরক্ষণ করার দাবি জানাই।
দেখা গেছে টিনশেডের এই ডাকঘরটির রয়েছে একটি দরজা ও দুটি জানালা। ডাকঘরটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮টি সিলমোহর, একটি বাইসাইকেল, একটি টেলিফোন সেট, লেটার বক্স, একটি সিন্দুক ও কিছু ডকুমেন্ট। ডাকঘরটির ঘর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এসব ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ও ডকুমেন্টগুলো সরিয়ে নিরাপদে রাখা হয়েছে।
রৌমারী উপজেলা পোস্টমাস্টার আল আমিন হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রথম ডাকঘরে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও ডকুমেন্ট সরিয়ে নিরাপদে রাখা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ডাকঘরটি সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা নিয়েছে। পরবর্তীতে ডাকঘরের জিনিসপত্র ও ডকুমেন্ট দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা করা হবে।
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নাহিদ হাসান খান বলেন, বাংলাদেশের প্রথম ডাকঘরটি সুরক্ষিত রাখতে ডাকঘরটির ওপরে কাঁচ দিয়ে একটি ঘর নির্মাণ করার নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করা হলে ডাকঘরটিতে ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র ও ডকুমেন্ট প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা হবে।