ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

ভাটি রাজার জঙ্গলবাড়ি

ঈশা খাঁ’র দুর্গ ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন পল্লি

মাজহার মান্না

প্রকাশিত: ০০:২৬, ১০ জুন ২০২৪

ঈশা খাঁ’র দুর্গ ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন পল্লি

কিশোরগঞ্জে করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে ঈশা খাঁ দুর্গের অন্দর মহলের ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ

অদম্য মনোবল, সাহস দেশপ্রেমকে পুঁজি করে তাঁরা লড়েছিলেন দুর্জয় মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। ১৫৭৬ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন আফগান সুলতান দাউদ খান কররানী পরাস্ত হলেও তাঁরা ১৬১২ সাল পর্যন্ত বাংলার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য অনবরত সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের কর্তৃত্বে ছিল বাংলা। পশ্চিমে ইছামতি নদী, দক্ষিণে গঙ্গা (পদ্মা) নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ সিলেটের বানিয়াচং পর্যন্ত সুবিস্তৃত ভাটি বাংলায় মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা ছিলেন একাট্টা। মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল এবং মির্জা নাথান তাঁদেরকেদাওয়াজদাহ বুমিঅর্থাৎবারো ভুঁইয়ানামে অভিহিত করেছেন।

ভাটি বাংলার সেই বার ভুঁইয়াগণের অগ্রণী ঈশা খাঁ ছিলেন অবিভক্ত ময়মনসিংহ, ঢাকা কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ অঞ্চল, নোয়াখালী, ফরিদপুর, পাবনা রংপুর জেলার কিয়দংশ এবং সিলেটের পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে গঠিত এক বিশাল রাজ্যের স্বাধীন অধিপতি। আবুল ফজল ঈশা খাঁকে বলেছেনমর্জুবানে ভাটিঅর্থাৎ ভাটির রাজা। রালফ প্রিচ তাঁকে বর্ণনা করেছেনম্রাহিসেবে। কবি এতীম কাশিম লিখেছেন, ‘বার বাংলার রাজা ঈশা খাঁন বীর। দক্ষিণ কুলের রাজা আদম সুধীর

ভাটির রাজা ঈশা খাঁ দ্বিতীয় রাজধানী ছিল জঙ্গলবাড়ি। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গলে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত জঙ্গলবাড়ি বর্তমানে ঈশা খাঁ দুর্গ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক এই দুর্গটি এক নজর দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ইতিহাস পিপাসু পর্যটকরা প্রতিদিন সেখানে ভিড় জমান। তারা এখানে এসে যেন সেই মোগল শাসনামলের দিকেই ফিরে যান। আগত পর্যটক স্থানীয় লোকজন দুর্গটিকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিল বহুদিন ধরে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভারত উপমহাদেশে মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে মোগলদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার না করায় বাংলার বীর হিসেবে খ্যাত মসনদ--আলা ঈশা খাঁ মোগলদের রোষানলে পড়েন। ফলে ঈশা খাঁকে বারবার মোগল সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেই সময় এই জঙ্গলবাড়ি দুর্গ থেকে ঈশা খাঁ যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সেটি ছিল ঈশা খাঁ-এর দ্বিতীয় রাজধানী। কথিত আছে, ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নরসুন্দা নদী তীরের জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি কোচ রাজা লক্ষণ হাজরাকে পরাজিত করে ঈশা খাঁ এই দুর্গটি দখল করেছিলেন। এরপর জঙ্গলে ঘেরা প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ জঙ্গলবাড়িতে তিনি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। এই জঙ্গলবাড়ি দুর্গ থেকেই তিনি বিশাল ভাটি এলাকা স্বাধীনভাবে শাসন করতেন।

জানা গেছে, প্রায় একযুগ আগে কিশোরগঞ্জ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদ পরবর্তীতে সংশোধিত নাম কিশোরগঞ্জ আরকিওলজিক্যাল সোসাইটির সভাপতি প্রত্নকর্মী আমিনুল হক সাদী তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বরাবরে বৃহত্তর ভাটি রাজ্যের রাজধানী জঙ্গলবাড়িটির উন্নয়নে জাদুঘর নির্মাণে একটি চিঠি লেখেন। সেই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগ থেকে একটি চিঠি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তৎপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিন পরিদর্শন করে একটি প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠান। পরে ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি প্রতœস্থলের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সরকার ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়।

বর্তমানে ১০ একর আয়তনের ষোড়শ শতকে বীর ঈশা খাঁ প্রতিষ্ঠিত জঙ্গলবাড়ি দুর্গটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। ইতোমধ্যে সেখানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্দেশে জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পর কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসন দুর্গের অধিগ্রহণকৃত জায়গার সীমানা চিহ্নিত করে লাল নিশানা উড়িয়ে আনুষ্ঠানিক দখলনামা বুঝিয়ে দিয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দুর্গটিকে কেন্দ্র করে জঙ্গলবাড়িকে একটি পর্যটনপল্লি হিসেবে গড়ে তোলা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। যাতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা জঙ্গলবাড়িতে ছুটে আসেন। এতে খুশি ঈশা খাঁনের বংশধরসহ স্থানীয় লোকজন।

জনশ্রুতি রয়েছে, বাংলার বার ভুঁইয়াদের অবিসংবাদিত নেতা ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁওয়ের নিকটবর্তী খিজিরপুর নামক স্থানে। মোগল সুবেদার মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে খিজিরপুর থেকে তিনি ব্রহ্মপুত্র শঙ্খ নদীর তীরবর্তী এগারসিন্দুরে আশ্রয় নেন। সেখানেও তার পরাজয় ঘটলে ঈশা খাঁ লক্ষণ সিং হাজরা নামে এক কোচ রাজার রাজধানী জঙ্গলবাড়ি আক্রমণ করে তা দখল করে নেন এবং সেখানেই তিনি তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন।

অনেকেই মনে করেন, লক্ষণ সিং হাজরা ঈশা খাঁ দুজনের কেউই জঙ্গলবাড়ি দুর্গটির মূল নির্মাতা নন। দুর্গ এলাকার বাইরে বিশেষ করে দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম অংশে অসংখ্য ইটের টুকরা মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ রয়েছে। প্রাপ্ত নির্দেশনাবলি সম্ভবত প্রাক-মুসলিম আমলের এবং এটি ছিল একটি সমৃদ্ধশালী জনবসতির কেন্দ্র। তবে দুর্গের ভেতরে বেশকিছু স্থাপনা রয়েছে ঈশা খাঁর। আছে তার বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ।

মূল ভবনটির ছাদ ধসে গেলেও দরবার কক্ষের অনেকটাই টিকে আছে। দরবার সংলগ্ন পান্থশালায় এখনো ১০-১২টি করে অস্তিত্ব দেখা যায়। পান্থশালার ধার ঘেঁষে চলে গেছে প্রাচীর। প্রাচীরের মাঝে মাঝে ফটক। ফটক ধরে ভেতরে গেলেই চোখে পড়ে বিধ্বস্ত অন্দরমহল। দেওয়ালে ফুল লতাপাতার আল্পনা। কয়েকটি থামও অক্ষত আছে। থামের গায়ে আছে লতাপাতার নকশা।

দুর্গের চারদিকে প্রমাণ করে, এটি ছিল বৃত্তাকার আকৃতির। দক্ষিণ, পশ্চিম উত্তর দিকে গভীর পরিখা খনন করা এবং পূর্বদিকে নরসুন্দা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়। বাড়ির সামনে রয়েছে সেই আমলের খনন করা একটি দীঘি। পাশেই রয়েছে মসজিদ।

ধারণা করা হয়, ঈশা খাঁর হাতেই হয়তো মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। মসজিদের কাছে ঈশা খাঁর বংশধরদের বাঁধানো কবর রয়েছে। ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গের একটি দরবার হল সংস্কার করে স্থানীয় প্রশাসন স্থাপন করেছেঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘর।সেখানে রয়েছে ঈশা খাঁর বিভিন্ন ছবি, তাঁর বংশধরদের তালিকা এবং বিভিন্ন নিদর্শন।

ঈশা খাঁ জঙ্গলবাড়িতে অবস্থান করে শাসন করতেন তাঁর ২২টি পরগনা। এখানে অবস্থান করেই তিনি সোনারগাঁও দখল করে সেখানে স্থাপন করেন নতুন রাজধানী। আর তখন থেকেই জৌলুস হারাতে থাকে জঙ্গলবাড়ি। বর্তমানে ভগ্নস্তূপের মাঝেও জঙ্গলবাড়িতে সাড়ে চারশবছরের স্মৃতি আজও টিকে রয়েছে যা বাঙালির অতীত শৌর্য-বীর্যের স্বাক্ষর বহন করে।

এখানকার সচেতন সুশীল নাগরিকবৃন্দ বীর ঈশা খাঁর দুর্গকে ঘিরে বিভিন্ন সময় নানা আয়োজন গ্রহণ করে থাকেন। দুর্গ চত্বরে আয়োজন করা হয় সাহিত্যানুষ্ঠান লোকজ মেলার। প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ গবেষকরা বলছেন, বার ভুঁইয়া খ্যাত বীর ঈশা খাঁ বাংলার গৌরব। শৌর্য, বীর্য বাঙালির স্বাধীনতার প্রতীক হচ্ছেন বীর ঈশা খাঁ।

জঙ্গলবাড়িতে বসবাসরত ঈশা খাঁর ১৫তম অধস্তন পুরুষ দেওয়ান জামাল দাদ খান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইট পরিচালক আমিনুল হক জানান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঠিকাদার সাজ্জাদুর রহমান সোহেলের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত দরবার হল মসজিদের সংস্কার কাজ পরিচালনা করছেন। তারা বলেন, দেরিতে হলেও দুর্গের সংরক্ষিত প্রত্নস্থলের সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কিশোরগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

×