ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

রুদ্ররূপে বৈশাখ

দারুণ অগ্নিবাণ শুষ্ক কঠিন ধরা

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২০ এপ্রিল ২০২৪

দারুণ অগ্নিবাণ শুষ্ক কঠিন ধরা

প্রচন্ড তাপপ্রবাহের কারণে তুলে রাখা ছাতা মাথায় দিয়ে পথ চলছেন অনেকেই

রুদ্ররূপে বৈশাখ। বছরের প্রথম মাস সবে শুরু হলো। তাতেই গরমাগরম অবস্থা। সূয্যিমামা রেগেমেগে অস্থির। সকাল হতে না হতেই  চোখ রাঙাচ্ছে। আর দুপুরে তো টেকাই যাচ্ছে না। দারুণ অগ্নিবাণে পুড়ছে চারপাশ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে/রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন/আরাম নাহি যে জানে রে...। আরাম সত্যি উধাও হয়ে গেছে। এখন সারাদেশেই বইছে তাপপ্রবাহ।

গাছের ছায়ায় দাঁড়ালেও গরম হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। অস্বস্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে ঘাম। অনবরত ঘামছে শরীর। সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা বা রাতেও গরমের খুব একটা হেরফের হচ্ছে না। কবিগুরুর বর্ণনার সঙ্গে পরিস্থিতি একদম মিলে যাচ্ছে, তিনি লিখেছেন: বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা।/পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা...।  
অবশ্য বৈশাখের এটাই নিয়ম। ধরাকে শুষ্ক কঠিন করে দেয়। তবে গত কয়েক বছরে অবস্থা বিশেষ খারাপ হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য, ১৯০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা ছিল ২৭ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক দুই ডিগ্রি  সেলসিয়াস। অথচ ২০১৪ সাল থেকে এ মাসে গড় তাপমাত্রা অধিক হারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে, যা অতীতের যে কোনো রেকর্ডকে অতিক্রম করে যায়।

২০১৪ সালে এপ্রিল মাসের গড় তাপমাত্রা বেড়ে প্রায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়। চলতি বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধেই ভয়াবহ সব লক্ষণ চোখে পড়ছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে গেছে। শনিবার যশোরে এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ঢাকার অবস্থাও খারাপ। একই দিন রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০. ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 
এ অবস্থায় গরম থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন অনেকেই। মাঝে মাঝে তাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক। খুব জরুরি না হলে অনেকে বের হচ্ছেন না। শনিবার ভরদুপুরে ফার্মগেটের মতো ব্যস্ত এলাকায় দাঁড়িয়ে দেখা গেছে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। গাড়ি কম।  লোকজনও ছিল হাতেগোনা। 
একই দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে দেখা গেছে, গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে বহু মানুষ। কেউ বসে গল্প করছেন। কেউ খালি গায়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন। রমনাপার্কসহ অন্য উদ্যানগুলোতেও ছিন্নমূল মানুষের ভিড়। প্রচ- রোদ থেকে বাঁচতে দূরন্ত ছেলে মেয়েরাও গাছের ছায়ায় চুপটি করে শুয়ে বা বসে ছিল।
গ্রীষ্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে নগরীর ফুটপাথগুলোতেও। এখন প্রায় সব ফুটপাথে ‘কলিজা ঠা-া শরবতের দোকান! পল্টনে দেখা গেল, বিশাল বরফ খ- টেবিলে পেতে রাখা হয়েছে। তা থেকে কুচি কুচি করে রাখা হচ্ছে গ্লাসে। লেবু নিংড়ে দেওয়া হচ্ছে রস। এভাবে যে শরবত প্রস্তুত হচ্ছে তা ঢক্ ঢক্ করে পান করছে পথিক! একইভাবে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফলমূল। ছোট ছোট আনারস ছিলে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে।

আর বিক্রি হচ্ছে শসা। হকাররা শশা কেটে পলিথিনে ভরে গণপরিবহনে ওঠে বিক্রি করছে। এসব দৃশ্য দেখে বুঝতে কারও বাকি থাকছে না যে, গ্রীষ্মকাল চলছে এখন।  তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহর দিন দিন হিট আইল্যান্ডে পরিণত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ শহরে গাছ তেমন নেই। কয়েক বছর আগে পরিবেশ সংগঠন পবার পক্ষ থেকে একটি জরিপ চালানো হয়।

তাতে দেখা গেছে, ১১ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল পল্টন মোড়, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ১ নম্বর গেট, শাপলা চত্বর এবং নিউমার্কেট বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। এসব এলাকার তাপমাত্রা অন্যান্য এলাকার চেয়ে ১ দশমিক ৫ থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। জরিপে জানা  গেছে, বৃক্ষ আচ্ছাদিত ধানমন্ডি লেক এলাকা ঢাকার যে কোন এলাকার তাপমাত্রা থেকে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি কম। অর্থাৎ, গাছ লাগানোর একটা তাগিদ এখান থেকে পাওয়া যায়। আরও কিছু উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নেওয়া উচিত। তা না হলে বৈশাখ বা গ্রীষ্ম নিয়ে কবিতা করা বাঙালির জন্য মুশকিল হয়ে যাবে হয়ত! আমরা কি তা চাই?

×