বেহাল অবস্থায় শাহবাগ শিশুপার্ক
এক সময় ঢাকা শহরে শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদনের প্রধান আকর্ষণ ছিল শাহবাগ শিশুপার্ক। যে কোনো সরকারি ছুটির দিন বা ঈদের ছুটিতে ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো শিশু-কিশোর এ পার্কে যেত। কিন্তু সংস্কার বা আধুনিকায়নের কার্যক্রম চলমান থাকায় পাঁচ বছর ধরে পার্কটি বন্ধ। সেখানে এখন নেই শিশু-কিশোরদের সেই চিরচেনা কোলাহল। পুরো পার্কজুড়ে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
পার্কটি চালু আছে বা পার্কের সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে, এমন ধারণা থেকে এখনো প্রতিদিন সকাল-বিকেল শিশু-কিশোরদের নিয়ে শাহবাগে যেতে দেখা যায় অভিভাবকদের। বিশেষত, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনেকেই পার্কটিতে ঘুরতে যাচ্ছেন। কিন্তু পার্ক চালু না হওয়ায় তারা আক্ষেপ আর হতাশা নিয়েই ফিরে যান।
অভিভাবকদের অভিযোগ, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে শিশুপার্ক আনন্দ-বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অথচ পার্কটি সংস্কারের নামে পাঁচ বছর ধরে তালাবদ্ধ করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। এটি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পার্কটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বিনোদনের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে ঢাকার শিশু-কিশোররা।
শাহবাগ শিশুপার্কের আগের নাম ছিল শহীদ জিয়া শিশুপার্ক। বর্তমানে পার্কটির নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক। এ পার্কের জায়গার মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। পার্কটি পরিচালনার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। তবে এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় পার্কটির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। পার্কিং নির্মাণের এই কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও অন্তত নয় মাস। এর পর পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কে রাইড স্থাপন করবে ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগ।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পার্কের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে এটি বন্ধ ঘোষণা করেছিল ডিএসসিসি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় শিশুপার্কের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন থাকায় অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী, প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। একই সময়ের মধ্যে শিশুপার্কের নিচে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসা পর্যটকদের গাড়ি পার্কিং ও কিছু অবকাঠামো সংস্কারকাজ শেষে এটি খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশু পার্কটিতে আধুনিক রাইড স্থাপনের কাজটি করবে ডিএসসিসি। এর জন্য স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ২৬৫ কোটি থেকে ৭৮ কোটি টাকা ডিএসসিসিকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ডিএসসিসি শুরু থেকেই এ বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি তোলে।
ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, শুরু থেকেই ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে, শিশুপার্কের বিদ্যমান রাইডগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, নতুন রাইড বসাতে হবে। রাইড বসানো ও পার্কের উন্নয়নে এ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ নিয়ে দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালি হয়।
তিনি বলেন, সাড়ে তিন বছর আগে দক্ষিণ সিটিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুপার্ক আধুনিকায়ন করতে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরে ডিএসসিসি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সম্প্রতি এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে। আগামী মে মাসে দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর পার্কটি উদ্বোধন করা হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, আগে শিশুপার্কটি যে জায়গায় ছিল, তার বেশিরভাগ অংশেই ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে পার্কিংয়ের ছাদ মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচুতে। এর মধ্যে কোন মডেলে পার্কিং হবে বা শিশুপার্কের নকশা কেমন হবে তার কোনো তথ্য বা থ্রিডি ছবি টাঙানো নেই। শুধু ফটকে ছোট্ট একটি টিনে লেখা- ‘সাবধান, পার্কের উন্নয়নকাজ চলিতেছে।’
ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শিশুপার্কের ভেতরে যে রাইডগুলো ছিল এখন তার অধিকাংশেরই অস্তিত্ব নেই। চরকি জাতীয় আলাদা দুটি রাইড আট ফুট উঁচু টিন দিয়ে ঘেরা। পার্কের পশ্চিম পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে বিমানবাহিনীর উপহার দেওয়া সেই জেট প্লেন। প্লেনের ওপর ধুলোর স্তর জমেছে, লতাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেখানে কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে পানি জমে থাকতেও দেখা গেছে।
ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে শাহবাগে ১৫ একর জায়গার ওপর শহীদ জিয়া শিশুপার্ক নামে এ পার্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে শিশুদের বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন থেকে পার্কটি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পার্কটিতে একটি খেলনা ট্রেন, একটি গোলাকার মেরি গো রাউন্ড রাইড ও একাধিক হুইলসহ ১২টি রাইড ছিল।
১৯৯২ সালে এ পার্কে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে সৌজন্য উপহার হিসেবে একটি জেট প্লেন দেওয়া হয়েছিল।
২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দ্বিতীয় পরিষদের ১১তম বোর্ড সভায় শহীদ জিয়া শিশুপার্কের নাম পরিবর্তন করে ‘ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’ করা হয়।
এর আগে ওই বছরেরই ২২ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার সড়ক, ভবন ও স্থাপনা নামকরণ সংক্রান্ত উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সুপারিশের আলোকে নতুন নাম প্রস্তাব করা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন পায়।