ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল উন্নয়নের এক মাইলফলক

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ১ ডিসেম্বর ২০২৩

কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল উন্নয়নের এক মাইলফলক

মূল ক্যাম্পাসে নবনির্মিত কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল

সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত কুষ্টিয়া জেলাবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এবং বহুল প্রত্যাশিত কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি অবশেষে দৃশ্যমান হয়েছে। দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের এক মাইলফলক প্রায় ৭শকোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট নবনির্মিত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। মূল ক্যাম্পাসে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

গত ১৪ নভেম্বর সকাল ১১টায় গণভবন থেকে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলার বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  মেডিক্যাল কলেজ প্রকল্পটির গোড়ার কথা, দেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৮-১৯৭৯ অর্থবছরে সরকার বগুড়া, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা, নোয়াখালী পাবনায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওই সময় কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং নিশান মোড় এলাকায় মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মেডিক্যাল কলেজটি পুনরায় অনুমোদন পায়। এর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং মেডিক্যাল শিক্ষার সুবিধার্থে দেশে আরও চারটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনায় ছিল ৫২ জন শিক্ষার্থী ধারণক্ষমতার কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ কিশোরগঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন। সে অনুসারে ২০১২ সালের মার্চএকনেকসভায়কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল স্থাপনশীর্ষক প্রকল্পটি অনুমোদন এবং ২০১৩ সালের অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই বছর কুষ্টিয়া-ঢাকা মহাসড়কের পাশে শহরের লাহিনীপাড়া এলাকায় ২০ একর জমির ওপর প্রথমে ২০৬ কোটি পরে ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৮২ কোটি ৪৫ লাখ হাজার টাকা। মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মধ্যদিয়ে। সময় জন অধ্যক্ষ জন প্রভাষক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩২ জন ছিল ছাত্রী। মেডিক্যালের অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে তখন ব্যবহার করা হয় কুষ্টিয়া মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ভবনকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুইজন ২০১২ সালের ২৭ জুলাই কুষ্টিয়ায় গড়াই নদীর পানিতে ডুবে মারা যায় এবং ১জন ভর্তি হলেও ক্লাস করেনি।

মৃত দুই শিক্ষার্থী কুমিল্লার শাহজালাল মজুমদার রিফাত দিনাজপুরের ফরিদুল ইসলাম মিলন। তাদের নামে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছেরিফাত-মিলনছাত্রাবাস। ফলে মেডিক্যালে ভর্তি সর্বশেষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৭ জন। ওই সময় থেকেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালটি শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যবহারিক শিক্ষা কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। এদিকে তলা একাডেমিক ভবন ২টি ছাত্র-ছাত্রী হলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে হাসপাতাল ছাড়াই কুষ্টিয়া ম্যাটস এর অস্থায়ী ভবন থেকে প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালে এপ্রিল লাহিনীপড়ায় মেডিক্যাল কলেজের মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে শুরু হয়েছে কলেজের নিয়মিত ক্লাস প্রশাসনিক কার্যক্রম।

নবমির্মিত কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের কোড নাম দেওয়া হয়েছে বাংলায়-‘কুমেক ১০ তলা ভিতের ওপর ৫০০ শর্য্যাবিশিষ্ট ৭ম তলা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল ভবনের নিচতলায় রয়েছে বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ, প্যাথলজি ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল রুম। ২য় তলায় হাসপাতালের প্রশাসনিক কার্যালয়, ডে-হসপিটাল, ২৩ বেডের সিসিইউ, পোস্ট সিসিইউ, লেবার ওয়ার্ড, স্টোর রুম ক্যাফেটেরিয়াসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা। ৩য় তলায় ১২টি অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ ইউনিট, ২০ বেডের আইসিসিইউ, ডে-হসপিটাল এবং ৪র্থ থেকে ৭ম তলা পর্যন্ত থাকছে ১২টি ওয়ার্ড ৮৮টি কেবিন। ছাড়া হাসপাতালে লিফটের পাশাপাশি রয়েছে স্টেচারে রোগী ওঠার জন্য একটি সুপরিসর ্যাম্প। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের আওতায় থাকছে এক্স-রে, এমআরআই, সিটি-স্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাম, সি-আর্ম মেশিনের মাধ্যমে বিভিন্ন পরীক্ষা, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ইসিজি, ইআরসিপি, এন্ডোসকপি, কলোনোস্কপি সুবিধা এবং আধুনিক প্যাথলজিক্যাল সেবা। বিভিন্ন ধরণের অপারেশনের মধ্যে হাসপাতালে থাকছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক্স সার্জারি, গাইনি অ্যান্ড অবস সার্জারি, ইউরোলজি সার্জারি, নিউরো সার্জারি, ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি, চক্ষু সার্জারি, নাক-কান-গলা সার্জারি ডেন্টাল সার্জারীর সুবিধা। ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আলাদা আবাসনের ব্যবস্থা। ছাত্রদের আবাসিক হলের নামরিফাত-মিলনছাত্রাবাস এবং মেয়েদের আবাসিক হলের নামরহিমা-আফসারছাত্রীনিবাস। দুটি হলই চারতলাবিশিষ্ট। ইন্টার্ন ডাক্তারদের জন্য আলাদা ভবণ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে মেডিক্যাল কলেজ প্রকল্পটির ৮৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাদবাকি কাজ চতুর্থ দফায় বর্ধিত সময় সময়সীমা ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বরের আগেই সম্পন্ন হবে বলে প্রকল্পটির তদারকি প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জানান। মেডিক্যাল কলেজের জন্য ৭০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ইতিমধ্যেই ক্রয় করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রকল্পটির নির্ধারিত নির্মাণকাল তিন বছর থাকলেও ইতোমধ্যেই পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। একে একে ৩য় দফায় এর সময় ব্যয় সম্প্রসারণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে। সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৮২ কোটি ৪৫ লাখ হাজার টাকা। চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। এর মধ্যে বেশির ভাগ কাজ করেছে মেসার্স জহিরুল লিমিটেড। বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে জেলাবাসীর পক্ষে একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার আমলে জেলা ছিল উন্নয়নের ছোঁয়াবঞ্চিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে একে একে পাল্টে যেতে থাকে কুষ্টিয়ার দৃশ্যপট। ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উন্নয়নের রূপকার খ্যাত কুষ্টিয়া সদর এমপি মাহবুব-উল আলম হানিফ। তাঁর তত্ত্বাবধানে জেলায় শুরু হয় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য উন্নয়নকাজের মধ্যে রয়েছে কুষ্টিয়া-হরিপুর সংযোগ সেতু, কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক, কুষ্টিয়া সুইমিংপুল কমপ্লেক্স এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমির অত্যাধুনিক কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ।

ফোর লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজও চলমান রয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলী বলেন, ‘এমপি মাহবুব-উল আলম হানিফের তত্ত্বাবধানে কুষ্টিয়ার জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়ন কর্মকা-গুলোর বেশিরভাগই সম্পন্ন হয়েছে। এসব উন্নয়ন কর্মকা- করে হানিফ ইতোমধ্যেই দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকার মানুষের কাছেউন্নয়নের রূপকারস্বীকৃতি পেয়েছেন

বিষয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের (প্রতিষ্ঠাকালীন) অধ্যক্ষ ডাক্তার ইফতেখার মাহমুদ তাঁর অনুভুতি ব্যক্ত করে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০১১ সালে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম শুরু করাটা ছিল আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের। এখানে কোনো অবকাঠামো ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ভবনের অভ্যন্তরে একটি কাঠের চেয়ার আর টেবিল নিয়ে মেডিকেল কলেজ যাত্রা শুরু করে। সেখানে ম্যাটসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আমরা ক্লাশরুম ব্যবহার করেছি। অতি পুরনো ডি-টাইপ কোয়াটারকে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেল বানিয়ে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। প্রথম ছয় মাস মেডিক্যালের কোনো বরাদ্দই ছিল না। অথচ হোস্টেলে রান্নাকরাসহ আমার প্রয়োজনীয় জনবলের দরকার ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের বেতন দিয়ে মাস পর্যন্ত চালিয়ে নিয়েছি। এভাবে ধিরে ধিরে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে যেতে থাকে।

ডাক্তার ইফতেখার আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিগ্রহণ করা জমি ছিল মূল সড়ক থেকে অন্তত ১০/১২ ফুট নিচে। সেখানে ধান ক্ষেতের মধ্যে ৯০ ফুট পাইলিং করে বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু করা হয়। এটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। সবকিছু মিলিয়ে সার্থকভাবেই আমরা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছি কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের বর্তমান প্রিন্সিপাল অধ্যাপক মাহাবুবু উর রহমান খান। এর আগে অধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক ডা. ইফতেখার মাহমুদ (প্রথম), ডা. জামাল উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক ডা. মীর মাহফুজুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তানজিদ, অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক দারা, অধ্যাপক ডা. সালেক মাসুদ মিয়া, অধ্যাপক ডা. শমসেদ বেগম অধ্যাপক ডা. দেলদার হোসেন দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কুষ্টিয়া সদর এমপি মাহবুব-উল আলম হানিফ, কুষ্টিয়া- আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়া- আসনের এমপি .. সরওয়ার জাহান বাদশা, জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের প্রকল্প পরিচালক ডাক্তার সরোয়ার জাহান চৌধুরী এবং কলেজের শিক্ষক সাংবাদিকসহ স্থানীয় সুধীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

 

×