ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শিশুরা ছাপা বই পড়ে কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে ​​​​​​​খুলছে অন্তরের চোখ

​​​​​​​সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২০:২৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শিশুরা ছাপা বই পড়ে কল্পনাশক্তি বাড়িয়ে ​​​​​​​খুলছে অন্তরের চোখ

বগুড়ায় ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারে পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে অন্যান্য বই পড়ছে শিশুরা

বগুড়া নগরীতে শিক্ষার্থীরা পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি কল্পনাশক্তি বাড়াতে লাইব্রেরি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ছাপা বই পড়ছে। নগরীতে হালে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের বিশেষায়িত গাড়ি ঘুরছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো স্কুল ছুটির পর আশপাশে থাকে। শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে গাড়ি কর্তৃপক্ষ সার্বিক সহযোগিতা দেয়। সদস্য হলে বই বাড়িতে নিয়ে পড়া শেষ হলে ফেরত দেয়। বগুড়া নগরীতে প্রাচীন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়া অন্য লাইব্রেরির পাঠক যেখানে খুব কম সেখানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির শিশু কিশোর পাঠক বেড়েছে। তাদের একজন রুমানা ইয়াসমিন বললআমাদের পছন্দের বই পড়ি। গাড়িতে এবং সদস্য হলে বাড়িতে নিয়ে পড়া যায়।আরেকজন শিশু পাঠক মেহজাবিন বলল, তাদের মা-বাবা বই পড়ার এই অভ্যাসে খুব খুশি। অভিভাবকগণ বেশি করে বই পড়ার উৎসাহ দেন। 

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ওছমান গনি বললেন, ছাপার অক্ষরে  লেখা বই মানবের অন্তরের হাজারো চোখ খুলে দেয়। সঞ্চারিত হয় জীবনীশক্তি। বর্তমানের শিশুরা এই পাঠাভ্যাস ধরে রাখলে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। অতীতে প্রাথমিক মাধ্যমিক বিদ্যায়াতনে শিক্ষকগণ পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ছড়া কবিতা গল্প উপন্যাসসহ নানা ধরনের বই পড়ার উৎসাহ দিতেন। বলতেন নিজেকে গড়তে শুধু পাঠ্যবই যথেষ্ট নয়। কল্পনাশক্তি (ইমাজিনেশন পাওয়ার) না থাকলে মেধার বিকাশ হবে না। তৈরি হবে না উপস্থিত বুদ্ধি। বিপথের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয় বই পড়ার আসক্তি, পাঠাভ্যাস।

অতীতে মধ্যবিত্ত পরিবারে বুক শেলফ, আলমারি, কাঠের বাক্সে বই থাকত। বলা হতো পারিবারিক লাইব্রেরি। পরিবারে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠত। বই মানব মনকে রাখে সজীব। সচল রাখে মস্তিষ্ক। বিষণœতা দূর করে সহানুভূতিশীল আত্ননির্ভরতা এনে দেয়। এভাবেই অতীতের তরুণ-তরুণীরা বই পড়ার অভ্যাসে জীবন গড়ে তুলেছেন। এই চর্চা কর্মক্ষেত্রকে সার্থক করে তেলার পথ দেখায়।

বর্তমান প্রজন্ম পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো বই পড়তে পারছে না! ছড়া কবিতা গল্পের বই ওদের হাতে দেওয়া হয় না। শিশুদের পাঠ্যবইয়ের চাপ দিয়ে ত্রাহী অবস্থায় ফেলে বন্দি রাখা হচ্ছে। ওরা ভোরের আলো দেখে না। সূর্যালোকের ভিটামিন ডি নেওয়ার আগেই পিঠে কয়েক কেজি বইয়ের বোঝা চেপে ছুটতে হয় স্কুলে। যে স্কুলে মাঠ নেই। পায়ের পাতায় শিশির লাগে না। বহুতল ভবনের খোপ। আলো বাতাস অপর্যাপ্ত। ফাস্ট ফুডে টিফিন শেষে বাড়িতে ফিরে ভাত মুখে দিয়েই ছুটতে হয় কোচিংয়ে। বিকালের সোনামাখা রোদ ওদের জীবনে উধাও। কখনো রাতেও কোচিং। বাড়ি ফিরে এইচ ডব্লিউ (হোম ওয়ার্ক) খাতা ঠিক করা। শিশুরা বাইরের বই পড়বে কখন। উৎসাহ দেওয়া তো দূরে থাক অভিভাবকদের জুলুম-জিপিএ- পেতেই হবে।

বগুড়া নগরীর সূত্রাপুরের আবুল কালাম আজাদের নাতনি মুশফিকা আল মামুন নক্সী (১২) মেধাবী এই শিশুর অভিভাবক আর দশজনের মতো। তবে নানা নাতিকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে চান। তিনি নাতনিকে ছড়ার বই কার্টুন বই, মজার বই কিনে দিয়ে পাঠাভ্যাস গড়ে দিচ্ছেন। মনিটরিং করে দেখেছেন, পাঠ্যবইয়ে যতটা জ্ঞান ছড়া মজার বই তাকে মেধাবী বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলছে। নক্সী তার নানাকে এখনই বলেভাইয়া এত বই ব্যাগে ভরে পিঠে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে গেলে তো কোমর বাঁকা হয়ে বুড়ির মতো হব!’ শিশুর মনোজগৎ বিকাশে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই পড়া দরকার। এতে শিশু মনের রঙিন স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে পারে। 

মুদ্রিত বই বা কাগজে বই পড়ার স্বাচ্ছন্দ চিরন্তনের। একটি বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রতিটি শব্দ পড়ার সময় মনে হবে অনেক কথার মালা গাঁথা হয়ে যাচ্ছে জীবনের আঙিনায়। খুঁজে পায় আলোয় ভরা পথ। হালে -বুক এসেছে। প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা কাগজের বইয়ের সঙ্গে -বইয়ের স্বাদ পাচ্ছে। অনেক বই পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরমেটে (পিডিএফ) পাওয়া যায়। বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েক তরুণ বললেন, নেটে বই পড়ে বেশিক্ষণ  ধৈর্য রাখা যায় না। ভাবনার দুয়ার সহজে খোলে না। ক্রিয়েটিভিটি এনে দেয় না। রেডিয়েশন চোখ ধাঁধিয়ে চাপ বাড়িয়ে দেয়। তবে রেফারেন্সের প্রয়োজনে ডিভাইসে যুক্ত বিশ্বে যে কোনো বই ডাউনলোড করা যায়। -বুক দূরকে কাছে এনেছে। কেড়ে নিয়েছে হৃদয়ের আবেগের সুপ্ত জায়গাটি। 

বর্তমানের শিক্ষার্থীরা যে একাডেমিক বই পড়ছে তার জরিপ খুবই কম। শিক্ষাবিদ .ত্বাইফ আল মামুন বলেছেন, বাংলা ইংরেজি যে মাধ্যমই হোক শিশুর জ্ঞানের বিকাশে নির্দিষ্ট ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হয়। প্রথম শর্ত হলো সঠিকভাবে পড়তে পারা। যা শুধু পাঠ্যবই পড়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন শিশুর জন্য অন্যান্য বই পড়ার পরিবশে। আবার পড়া অর্থ শুধু পড়ে যাওয়া নয়। প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে পড়তে হবে। থাকতে হবে কাক্সিক্ষত গতি। আন্তর্জাতিক সংস্থা রুম টু রিডের এক জরিপ : দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শব্দ বুঝে উচ্চারণ করে মিনিটে গড়ে ৩৩ শব্দ। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডে মাতৃভাষা উচ্চারণে পড়ার হার মিনিটে ৪৫ থেকে ৬০ শব্দ। . মামুন বলেছেন শিশুদের পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বইমুখী করতে হবে। বই পড়ার আসক্তি জীবন গড়ে দেয়। প্রয়োজনে শিশুদের অবসর সময় বের করে দেওয়া।

×