
.
অপরাধ জগতের ত্রাস হিসেবে পরিচিত ৬২ বাংলাদেশীর নাম ঝুলছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশনের (ইন্টারপোল) রেড নোটিসের তালিকায়। পুলিশ সদর দপ্তরে তালিকায় রয়েছে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে ১৮ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় মোট ৬২ জন অপরাধীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। দুর্ধর্ষ অপরাধীর তালিকায় আছে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম। বছরে পর বছর ধরে চেষ্টা করেও এসব পলাতক অপরাধীকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় থাকা ১৮ শীর্ষ সন্ত্রাসীও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার ও ওমান থেকে ১৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকার পরও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ নামের এক অপরাধীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। সে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্টারপোলের মাধ্যমে কামরুল নামের এক হত্যা মামলার আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। রাজধানী ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি সুমন সিকদার ওরফে মুসাকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল ডেস্কের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। দাপ্তরিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তরকে এনসিবির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর অবস্থান, ছবি ও পরিচয় সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ইন্টারপোলকে অবহিত করলে সহায়তা করে সংস্থাটি। ইন্টারপোলের লাল নোটিসে থাকা কোনো অপরাধী গ্রেপ্তার হলে কিংবা মারা গেলে তার নাম ওই নোটিস থেকে মুছে ফেলা হয়। পাঁচ বছরে একবার ওই নোটিসে নামের তথ্য আপডেট করা হয়। অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হলেই শুধু হয় না, ছবি ও নামের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অবস্থান নিশ্চিত হলেও অপরাধীরা অবস্থান বদলে ফেলেন। আবার অনেকে অন্য দেশের পাসপোর্টে সেই দেশ বা অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের শনাক্ত করা বা দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের আইনও অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সূত্র জানায়, কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তার ছবি। কিন্তু বাংলাদেশী এসব অপরাধী ছবির মতোই যেন স্থির! সবশেষ এ তালিকায় যুক্ত হয় দুবাইয়ে বাংলাদেশের আলোচিত সোনা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার আসামিও সে। অনেক বিষয়ের মতো মাস ছয়েক আগে হইচই ফেলে দেওয়া আরাভ ইস্যুও চলে গেছে লোকচক্ষুর অগোচরে। বাংলাদেশ পুলিশের চেষ্টায় গত ২৩ মার্চ আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। মাঝে আরাভ খান দুবাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। ইন্টারপোলের রেড নোটিস মাথায় নিয়েই দুবাই চষে বেড়াচ্ছে আরাভ। সেখান থেকেই নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে এত কিছুর পরেও আরাভ ইস্যু এখন আলোচনায় নেই।
ইন্টারপোলের রেড নোটিসে ৬২ বাংলাদেশী ॥ ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে রেড নোটিস অব ওয়ান্টেড পারসন্স তালিকায় বিভিন্ন দেশের মোট ছয় হাজার ৯২৬ জন অপরাধীর নাম ও জাতীয়তা তথা দেশের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী ৬২ অপরাধীর নাম। এর মধ্যে বাংলাদেশী হচ্ছেÑ রবিউল ইসলাম ওরফে রবিউল (আরাভ খান), জাফর ইকবাল, তানজিরুল স্বপন, মোল্লা নজরুল ইসলাম, মিন্টু মিয়া, ওয়াসিম, খোরশেদ আলম, গিয়াস উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, মিজান মিয়া, চন্দন কুমার রায়, রাতুল আহমেদ বাবু, সিরাজ মোস্তফা ওরফে মো. লালু, হারিস চৌধুরী, জাহিদ হোসেন খোকন, মো. সাঈদ হোসাইন ওরফে হোসেন, সাঈদ মোহাম্মদ হাসান আলী, আজিজুর রহমান, অজয় বিশ্বাস, তরিকুল ইসলাম, হানিফ, আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, মো. সবুজ ফকিদ, মো. মনির ভূঁইয়া, শফিক-উল, আমান উল্লাহ শফিক, আবুল কালাম আজাদ, জাহিদুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন খান, মোহাম্মদ ইকরাম খান ওরফে নাঈম খান, ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, মো. ইউসুফ, আব্দুল আলীম শরীফ, মজনু আহমেদ, নুরুল দিপু, মোহাম্মদ ফজলুল আমিন জাবেদ, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আব্দুর রশিদ খন্দকার, নাজমুল আনসার, শরফুল হোসেন আহমেদ, শরিফুল হক ডালিম, রউফ উদ্দিন, মোসলিম উদ্দিন খান, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ তাজ উদ্দিন মিয়া, সালাহউদ্দিন মিন্টু, গোলাম ফারুক অভি, শেখ হারুন, সুজিত সুলতান, তৌফিক আলম, জাফর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, জিসান আহমেদ জিসান, আমিনুর রাসুল, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, নবী হোসেন, সুব্রত বাইন ত্রিমতি, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস ও আব্দুল জব্বার।
পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় শীর্ষ ১৮ সন্ত্রাসী ॥ পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলো- আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আমিনুর রসুল ওরফে টোকাই সাগর, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আরমান ওরফে সুমন, কামাল পাশা ওরফে পাশা, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, ইমাম হোসেন, খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসু, সোহেল রানা ওরফে ফ্রিডম সোহেল ও খন্দকার নাঈম আহমেদ টেটন।
বঙ্গবন্ধুর খুনিকেও ফেরানো যায়নি ॥ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে আদালতের রায়ে ১১ জনের ফাঁসির দ- দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনের এখন পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকি আরও পাঁচজন পলাতক আছে। তারা হচ্ছেÑ আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে, আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছে, সেই তথ্যও নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিস ইস্যু করতে হলে যেমন কিছু পদক্ষেপ থাকে, তেমনি কারও বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা থাকা ও ওয়ারেন্ট ইস্যুসহ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে রেড নোটিস ইস্যু করা হয়। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ ক্যাটাগরিতে যে ৬২ অপরাধীর তালিকা রয়েছে, তাদেরও যথাযথ আইন মেনে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।