
.
প্রাগৈতিহাসিককালে বাংলাদেশ অঞ্চলে ধান ছাড়াও বিকল্প অনেক ফসলের চাষ হতো। এ সবের মধ্যে মিলেট জাতীয় দুই ফসল কাউন এবং চিনা, বিভিন্ন জাতের ডাল, ধানী শিমসহ মোট ৮০ প্রজাতির উদ্ভিজ্জ উপাদানের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিদেশে উন্নত ল্যাবরেটরিতে মরফোমেট্রিক পরীক্ষার মাধ্যমে এসব প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রত্নউদ্ভিদ বিজ্ঞানী মিজানুর রহমান।
তারও আগের প্রায় সব গবেষণা বলছে, অনাদিকাল ধরেই বাংলাদেশ ছিল চাষাবাদের উৎকৃষ্ট অঞ্চল। কৃষি অনুকূল পরিবেশ-প্রতিবেশ এখানে ছিল। অজস্র ধারায় প্রবাহিত হতো নদ-নদী। পানির উৎসের অভাব ছিল না। সর্বোপরি মাটি ছিল উর্বর। এসব বৈশিষ্ট্য আদি কৃষিকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। তাছাড়া ঋতু বৈচিত্র্যর কারণে বৈচিত্র্য এসেছিল শস্য উৎপাদনেও। একেক ঋতুতে একেক শস্যের আবাদ হয়েছে।
এভাবে কালক্রমে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ অঞ্চলের শস্য ভান্ডার। প্রাচীন এই শস্য ভান্ডার নিয়ে আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো গবেষণা হচ্ছে। এ পর্যন্ত গবেষণায় বিচিত্র শস্যসহ নানা উদ্ভিদ, এমনকি, শাক সবজির তথ্য উঠে এসেছে। প্রাচীন সাহিত্যে, পৌরাণিক গল্পগাথায় পাওয়া গেছে অনেক ফল-ফসলের নাম। তবে বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক শস্যের প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানী মিজানুর রহমানের আদিমশস্য গবেষণা সে ঘাটতি কিছুটা হলেও দূর করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মাটি পরীক্ষা করে ধান ছাড়াও বিকল্প অনেক প্রত্ন ফসলের সন্ধান পেয়েছেন এই গবেষক।
যুক্তরাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডে গবেষণারত বাংলাদেশী তরুণ হোয়াটসঅ্যাপ কলে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে আমি মোট ৮০ প্রজাতির উদ্ভিজ্জ উপাদান সংগ্রহ করেছিলাম। সেগুলোর প্রতিটির জাত শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এখনো। তবে যেসব শস্য শনাক্ত করা গেছে, সেগুলোর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। উল্লেখযোগ্য শস্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মিলেট জাতীয় দুই ফসল কাউন ও চিনা, ধানী শিম এবং বিভিন্ন ধরনের ডাল।’
নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে প্রত্নকৃষি গবেষক বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা থাকায় দূর দূরান্ত থেকে আদিম মানুষ আজকের বাংলাদেশ অংশে আসতে শুরু করে। আসার সময় অনেকেই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বিভিন্ন শস্যবীজ। জীবন ধারনের জন্য বীজ থেকে শস্য উৎপাদনে মনোযোগী হন তারা। ধান চাষই ছিল মূল জীবিকা। তবে ধান চাষ কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিকল্প হিসেবে অন্য একাধিক খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হতো।’ বৈচিত্র্যপূর্ণ ঋতু কৃষিতেও বৈচিত্র্য এনেছিল বলে জানান তিনি।
মিজানুর রহমানের দেওয়া তথ্য মতে, কাউন এবং চিনা আদিকালে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীনের উত্তরাঞ্চলে বুনো অবস্থা থেকে চাষাবাদের আওতায় এসেছিল। পরবর্তীকালে উত্তর চীন থেকে প্রায় সারা দুনিয়াতে এ ফসল ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের উয়ারী-বটেশ্বর থেকে ৩০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের ফসল দুটি পাওয়া যায়। তবে এগুলো কি সরাসরি চীন থেকে উয়ারী-বটেশ্বরে এসেছিল? নাকি ভারতের মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকা হয়ে এসেছে? এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান গবেষক।
আদি কৃষি গবেষণার অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, এই ভূখন্ডে ভাতের পরেই মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল কাউন। এটি মূলত অনুর্ভর উঁচুজমি ও কিছুটা শুষ্ক সময়ের ফসল। অনাবৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে ধান কম হলে, উৎপাদন বিঘিœত হলে কৃষকরা কাউনের ওপর নির্ভর করতেন বলে ধারণা করা হয়। খাবার হিসেবে কাউন অত্যন্ত উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন। বর্তমান বাংলাদেশের চরাঞ্চলের বালিমাটিতে কাউনের চাষাবাদ হয় বলে জানা যায়। চিনার ছোট ছোট গোলাকার দানা গরম পানিতে সিদ্ধ করে ভাতের মতোই খাওয়া যায়। এখনো দেশের কিছু কিছু এলাকায় চিনা চাষ হয়।
এই ভূখন্ডে ভাতের ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ডালের ইতিহাসটিও। গরিবের বাড়িতে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে যাবেন- এমন বিনয়ী উচ্চারণের সঙ্গে বাঙালি মাত্রই পরিচিত। কিন্তু ভাত ও ডালের মধ্যকার এই সম্পর্ক আজকের নয়। মিজানুর রহমানের আদিম শস্য গবেষণা বলছে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেও এ সম্পর্কটি বিদ্যমান ছিল। কারণ তখন ধান চাষের যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে, তেমনি পাওয়া গেছে ডাল চাষের প্রমাণও। এমনকি যে মাটিতে ধান পাওয়া গেছে ঠিক সে মাটিতে থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে ডাল। প্রাগৈতিহাসিককালে চাষ হওয়া ডালগুলোর মধ্যে মসুর, মটর, কালাই ও মুগ ডাল চাষাবাদের প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানান মিজান।
অন্যান্য গবেষণা মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রান্না হওয়া মসুরের ডাল মূলত মধ্যপ্রাচ্যে চাষ হতো। ধারণা করা হয়, মধ্য-গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল মসুর ডাল। ধানী শীম উৎপত্তি লাভ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এই ডাল সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে কেবল মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে পাওয়া গেছে।
তবে এই আদিমশস্যগুলো নিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন মিজানুর রহমান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘গবেষণার শুরুর দিকে আমি প্রত্নস্থানের মাটি সংগ্রহ করেছিলাম কৌতূহলবশত। মাটিতে কী পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে অনুমান ছিল না। পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় কখনো ধান পেয়েছি। কখনো মিলেট বা অন্য উদ্ভিদ। কিন্তু যে কোনো একটি ধরে গবেষণা করলেও বছরের পর বছর লেগে যায়। তাই আপাতত প্রত্নধান নিয়ে কাজ করছি আমি। বাকি শস্যগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে তিনি অথবা অন্য কেউ গবেষণা করবেন।’
এভাবেই কোনো একদিন বাংলাদেশের আদিম শস্যের সম্পূর্ণ ভান্ডার সম্পর্কে বিজ্ঞান নির্ভর তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন আপাতত একলাটি হয়ে থাকা দেশের প্রথম প্রত্নউদ্ভিদ বিজ্ঞানী মিজানুর রহমান।