ব্রহ্মপুত্র নদে পাল তোলা নৌকা
প্রকৃতির অভিনবত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে শরতকে কাছে পাবার তাড়না সবার মাঝে বিরাজ করে। শরৎ আর কাশফুল একই নদীর দুটি ধারা। শরতের দিগন্ত জোড়া মাঠে সাদা কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে? প্রেম জাগ্রত হয় শিশুদের মনেও।
বাঙালি হিসেবে আমাদের রয়েছে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিক যানবাহনের বহুল প্রচলনের আগে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী আর নৌকা। যুগের হাওয়া লেগেছিল পালে, দ্রুত থেকে দ্রুততর ছুটতে হবে আমাদের। তাই দ্রুত ছুটে যাচ্ছি আমরা মৃত্যুর দিকে, ধারণ করে চলছি যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই পাল তোলা নৌকাতে এখন আর আমাদের চলে না। ইঞ্জিন চালিত নৌকা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ মরে যাচ্ছে। এতে আমাদের সন্তানেরা পাচ্ছে বিষাক্ত পরিবেশ।
কবিগুরু তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির সেই রূপ চিরন্তন হয়ে আছে। বর্ষা-শরৎ মানব হৃদয়ে রোমান্টিকতার যে সুর তুলে ধরে তা অন্য কোনো ঋতুতে মেলে না। বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর যতই পরিবর্তন হোক বাংলার ষড়ঋতুর হেরফের হতে পারে। কিন্তু বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসতে এখনো অনেক দেরি। এই সময়টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে উত্তাল ঢেউ নেই, নদীতে জলরাশির স্তব্ধতা, আকাশ একটু মেঘলা হলেই ঢেউ নেচে ওঠে।
নদীর তীর ও কোথাও সামান্য সবুজ কোথাও নদীর কিনারে কাশফুল ঘেঁষে যখন নৌকা বয়ে যায় তখন মাঝিদের সঙ্গে যাত্রীরা অনুভব করে অনাবিল সুখ। এই সময়ে প্রকৃতির বাতাস এসে দোল খায় পাল তোলা নৌকায়।
একটা সময় নদীর কিনারা দিয়ে গুনটানা নৌকা চলত, যা এখন আর তা চোখে পড়ে না। বাতাসের অনুকূলে যাওয়ার জন্য বড় কাপড় দিয়ে আটকানো হতো পাল তোলা নৌকা। আজকাল তাও কমে গেছে। নৌকার পালকে কোন কোন এলাকায় বলা হয়ে থাকে বাদাম। যার নৌকায় যত বড় বাদাম থাকত তত বড়। সেই নৌকা বাতাসের গতির সঙ্গে চলত।
নদী, হ্রদ কিংবা সমুদ্র তীরবর্তী এক জনপদের সঙ্গে আরেক জনপদের যোগাযোগে সাহায্য করে আসছে নৌকা।
বহু বছর আগে থেকেই বাংলাদেশের নদ-নদী খাল-বিল অজস্্র এমন অনেক এলাকা রয়েছে আজও, যেখানে মানুষের জীবন নৌকা ছাড়া অচিন্তনীয়। কিন্তু এ বাহনটির ইতিহাস কি তা কেউ জানে না। তবে নৌকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগে¦দে।
মানসা মঙ্গল ও বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস কাব্যে বনিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যতরী ১৪ ডিঙ্গা নির্মাণ করে বাণিজ্য যাত্রা করেছিলেন। ক্রিট দ্বীপের মানুষেরা এক লাখ ৩০ হাজার বছর আগে নৌকার ব্যবহার জানত বলে জানা যায়।
ব্রহ্মপুত্র নদের কাশফুল দেখতে ঘুরতে আসা গফরগাঁও বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল কাইয়ুম, ইলিয়াছ, শফিকুল, জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, একটা সময় এই ব্রহ্মপুত্র নদে জাহাজ ও হাজার মণি নৌকা চলাচল করত। পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়ার কারণে এখন আর সেই দিন নেই।
তবুও একটু প্রশান্তির জন্য ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এক খ- জমিতে কাশফুলের সৌন্দর্য ও মাঝে-মধ্যে পাল তোলা নৌকা দেখে মন জুড়িয়ে যায়। তাই এখানে এসেছি।
বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙি। নদীর তীরে যারা বসবাস করেন তারা সকলেই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিষ্কৃত নৌকা সবচেয়ে পুরনো ৭ থেকে ১০ হাজার বছর আগে। কুয়েতের ফাইলাকা দ্বীপে পাওয়া সমুদ্রগামী জাহাজ বা ‘রিড বোট’ তৈরি হয়েছিল ৭ হাজার বছর আগে। মহাসাগরে খ্রিস্টপূর্ব ৪ হাজার থেকে ৩ হাজার সালে প্রচুর জলযানের আনাগোনা ছিল বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছে। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
এখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরে বহু দাঁড় বিশিষ্ট নৌকা দেখা যেত। নৌকায় দাঁড় টানার কাজে ব্যবহার করা হতো কৃতদাসদের। দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়া অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও ক্লান্তিকর। পালের উদ্ভাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যায় এবং হাওয়ার গতিতে নৌকা আরও বেশি বেগবান হয়। তখন থেকেই নানা ধরনের পালের ব্যবহার শুরু হয় বাতাসের শক্তি কাজে লাগানোর জন্য ।
বাংলার বারভুঁইয়াদের একটা বিরাট বহর ছিল। ঈশা খাঁ ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে নবাবদের বিতাড়িত করেন রণতরীর সাহায্যে। বিক্রমপুরের কাছে নৌযুদ্ধে মানসিংহের নৌ বহরের ওপর তার চূড়ান্ত বিজয় ষোড়শ শতকে বাংলার নৌ শক্তির একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাল তোলা নৌকার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। নদীতে মাঝে-মধ্যে পালের নৌকার দেখা মেলে। পাল তোলা নৌকা চলাচলের দৃশ্য এখন বিরল, এটি এখন কেবলই স্মৃতি।