ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনে করিয়ে দিচ্ছে ঢাকা গেট

১৬ শতকের ঐতিহ্য, মীর জুমলার স্মৃতি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৬ মে ২০২৩

১৬ শতকের ঐতিহ্য, মীর জুমলার স্মৃতি

শিক্ষিত সচেতন মানুষের শহর ঢাকায় চরম অযতœ-অবহেলার শিকার ঐতিহ্যবাহী মীর জুমলার গেট বা ঢাকা গেট

একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে, আরও স্পষ্ট করে বললে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিদ্বান মানুষজনের চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছিল একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। স্থাপনাটি মীর জুমলার গেট নামে পরিচিত। বিশ^বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথেই এর অবস্থান। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সকাল-বিকেল দেখেছেন। দেখছেন। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি কেউ। একই কথা বাংলা একাডেমির বেলায় প্রযোজ্য হবে। সরকারি হলেও প্রতিষ্ঠানটিকে বাঙালির মেধা মননের প্রতীক বলা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার সময়ও পুরাকীর্তিটি নিশ্চিত চোখে পড়ে। কিন্তু একাডেমি ঐতিহ্য রক্ষার ‘বাড়তি দায়’ কাঁধে তুলেনি।

সর্বোপরি দৃষ্টি দেয়নি সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর। সিটি করপোরেশনের কত ‘বড় বড়’ কাজ! সেসব ‘বড়’ কাজ নিয়ে বছরের পর বছর তারা ব্যস্ত থেকেছেন। এ অবস্থায় কদিন পর পরই গণমাধ্যমে খবর আসছিল, অযতœ-অবহলোয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ঢাকা গেট। ইতিহাসবিদ ও ঢাকা গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এবং অতঃপর, ‘আল্লাহর কী কুদরত’ বলতে হবে, বিষয়টি আমলে নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন! মেয়র ফজলে নূর তাপস ঢাকার ঐতিহ্যকে সাতটি বলয়ে ভাগ করে সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছেন। এরই অংশ হিসেবে বুধবার ঢাকা গেট সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। ফলে নতুন করে সামনে এসেছে মীর জুমলা গেটের ইতিহাস।    
ইতিহাসবিদের মতে, এটি মোগল স্থাপনা। নির্মাণ করেছিলেন মীর জুমলা। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার সুবেদার ছিলেন তিনি। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ থেকে জানা যাচ্ছে, স্থাপনাটি ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে নির্মিত। ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করতে এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। মোগল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে এ তোরণ ব্যবহার করা হতো। তখন এর নাম ছিল মীর জুমলার গেট। এর অনেক পরে ময়মনসিংহ গেট বা ঢাকা গেট এবং তারও পরে রমনা গেট নামকরণ করা হয়।

গেটটি রমনায় প্রবেশ করার জন্য ব্যবহার করা হতো বলে সাধারণ মানুষের কাছে এটি রমনা গেট নামেও পরিচিতি পায়। তবে বাংলাদেশ সরকারের গেজেট অনুসারে এ তোরণ এবং আশপাশের জায়গার নাম মীর জুমলার গেটই আছে। অপর এক তথ্যে বলা হয়েছে, ইসলাম খাঁর আমলে রমনা অঞ্চলে বাগে বাদশাহী নামে মোগল উদ্যান ছিল। বাগে বাদশাহীর প্রবেশপথে ছিল দুটি স্তম্ভ। পরে তা পুনর্র্নির্মাণ করা হয়। 
অবশ্য ভিন্নমত দিয়েছেন ইতিহাসের আরেক দিকপাল এ এইচ দানী। তোরণ পরীক্ষা করে তিনি বলেছেন, এগুলো মোগল আমলে তৈরি হয়নি। কারণ স্তম্ভ দুটির গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের। মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য রেসকোর্সের উত্তর-পূর্বদিকে একটি রাস্তা তৈরি করেন তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। একই সময় রাস্তার প্রবেশমুখে এ দুটি স্তম্ভ তৈরি করেন তিনি, যা এখনো দৃশ্যমান।  
এভাবে যুগ যুগ ধরে এই গেটটি ঘিরে ঢাকার ইতিহাস অনুসন্ধান ও চর্চা হয়েছে। মীর জুমলার গেটের নির্মাণশৈলীও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল গবেষকদের। তাদের গবেষণা মতে, প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধÑ এ ধরনের স্তম্ভ খুবই বিরল। যার ওপরে রয়েছে কারুকাজ করা চারকোণা বিশিষ্ট শেড। পশ্চিম পাশের বড় স্তম্ভের পাশে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট আরেকটি স্তম্ভ। যার মাঝে টানা অবস্থায় আছে একটি দেওয়াল। উঁচু থেকে নিচুতে নামা এ দেওয়ালটি প্রায় ২০ ইঞ্চি চওড়া। কিন্তু পূর্বপাশের বড় স্তম্ভের সঙ্গে দেওয়াল বা প্রাচীর থাকলেও ছোট স্তম্ভ অনুপস্থিত।
বর্তমানে গেটের তিন অংশের একটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন তিন নেতার মাজার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য অংশটি পড়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সীমানার ভেতর। গেটের মূল চেহারা ধরা পড়ে দুপাশের স্থাপনায়। মাঝখানের অংশটি মোটা গোলাকার পিলারের মতো। মেট্রোরেলের নিচে হলেও, চোখ এড়ায় না। তবে গেটের মূল দুই অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সীমানার ভেতরে পড়া অংশটি দেখে মনে হয়, সামান্য বাতাসেই ভেঙে পড়ে যাবে। অযতœ-অবহেলা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তা এই অংশটি না দেখলে অনুমান করা কঠিন। পলেস্তারা খসে পড়ছে। ফাটল ধরেছে দেওয়ালে। সেই ফাটলে বট গাছ গজিয়েছে। শেওলার জন্য দেওয়ালটিকে দেওয়াল মনে হয় না। সব মিলিয়ে ভুতুড়ে একটা ব্যাপার। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের স্থাপনাটিও একইরকম অযতœ- অবহেলার শিকার হচ্ছে। 
তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান উদ্যোগের ফলে ইতিহাসটি নতুন করে প্রাণ পাবে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদরা। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেছেন, আমরা তো সবসময়ই ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার কথা জোর দিয়ে বলে এসেছি। কিন্তু কথা তো কেউ শুনতে চায় না। শিক্ষিত লোকেরাই অন্ধের মতো আচরণ করেন। একই কারণে রাজধানীর ভেতরেই গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটি ধ্বংস হচ্ছিল। 
সিটি করপোরেশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার অন্যান্য ঐতিহ্য রক্ষায়ও মেয়র উদ্যোগ নিয়েছেন। এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে কাজটি অব্যাহত রাখতে হবে। 
আরেক ঢাকা গবেষক হামেম সূফি বলেন, বহু বছরের প্রাচীন নগরী ঢাকা। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই শহর বিচিত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে। কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় এসবের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। আগামী প্রজন্মকে ঢাকার ইতিহাস জানানোর স্বার্থে এখন যেসব পুরাকীর্তি অবশিষ্ট আছে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি। 

×