ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

​​​​​​​চন্দ্রদ্বীপের ঐতিহ্য

কালারাজার মাটি খুঁড়তেই উঠে এলো প্রত্নসামগ্রী

​​​​​​​শংকর লাল দাশ

প্রকাশিত: ২২:৫১, ২৬ মার্চ ২০২৩

কালারাজার মাটি খুঁড়তেই উঠে এলো প্রত্নসামগ্রী

গলাচিপায় পুকুর খনন করতে গিয়ে মাটির নিচে পাওয়া প্রতœসামগ্রী

গাঁয়ের নামকালারাজা এক সময়ে এর পরিচিতি ছিল কালারাজার বিল নামে। অর্থাৎ যত দূরে দৃষ্টি যায়, কেবলই ধু ধু প্রান্তর। পরবর্তীতে ধানী জমিতে রূপ নেয়। আর এখন বর্ধিষ্ণু গ্রাম। জনকোলাহলে পরিপূর্ণ এক জনপদ। জনপদের মাটির তলায় লুকিয়ে রয়েছে অন্তত পাঁচশ বছরের প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। যা এলাকার মানুষের কাছে ছিল একেবারেই অজানা। পুকুরের জন্য মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো সে সম্পদের নিদর্শন। আর প্রত্নসম্পদের নিদর্শন প্রমাণ করেছে, কালারাজার বিল নিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ধরে প্রচলিত গল্প, কিচ্ছা, জারি সারি, গান, ছড়া, প্রবাদ, পুঁথি কিছুই মিথ্যে নয়। সবই নিরেট সত্য।

এখানেই একদিন ছিল স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজধানী। ছিল রাজভবন। ছিল রাজা মন্ত্রী উজির নাজির। হাতিশালে হাতি। ঘোড়াশালে ঘোড়া। নগর কোতোয়াল। আড়াইশ বছর আগে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামিতে বিলুপ্ত হয় সে নগর সভ্যতা। যা এখন ফিরে এসেছে আবদুল মান্নান নামের এক গৃহস্তের কোদালের আগায় ইতিহাসের উপাদান হয়ে প্রত্নসামগ্রী হিসেবে।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে পূর্ব-উত্তর দিকে ১৫-১৬ কিলোমিটার সড়ক পথ ধরে এগুলেই বাঁ হাতের পাশে পড়বে কালারাজা গ্রাম। গ্রামের রাজবাড়ির বাসিন্দা পঞ্চান্ন বছরের আবদুল মান্নান মৃধা ২০১৫ সালে বাড়ির পাশে পুকুর খনন শুরু করেন। মাটির নয় ফুট গভীরে যেতেই উঠে আসে একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজাদের ব্যবহৃত কাঠের তৈরি হ্যান্ডস্টিক বেলচা জাতীয় বস্তু, পোড়ামাটির তৈরি বেশ কয়েকটি প্রদীপ দানি, অজানা প্রাণির হাড়গোড় প্রভৃতি। আবদুল মান্নান মৃধা মাটির তলা থেকে উঠে আসা প্রত্নবস্তুসমূহের প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে অত্যন্ত যত্নে সঙ্গে সংরক্ষণ করেন।

তবে কিভাবে এবং কোন সংস্থার কাছে তিনি তা হস্তান্তর করবেন সম্পর্কে তার কোন ধরনের ধারণা ছিল না। ফলে প্রত্নসম্পদগুলো বাড়িতেই রেখে দেন। দৃশ্যপট পাল্টে যায় ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে। ওই সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি জরিপ দল গলাচিপা উপজেলায় অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। জরিপ দল তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্নবস্তুগুলোর ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য যাছাই করে অবিলম্বে মান্নান মৃধাকে তা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিকট হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে করোনাকালীন পরিস্থিতির কারণে তা বিলম্ব হয়। শেষ পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার স্বাক্ষরিত চিঠির নির্দেশনা অনুযায়ী গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিউদ্দিন আল হেলালের কার্যালয়ে এবং তার উপস্থিতিতে এসব প্রত্নসামগ্রী হস্তান্তর করা হয়। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌসের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রত্নসম্পদগুলো গ্রহণ করেন। প্রত্নসম্পদ গ্রহণকারী দলে আরও ছিলেন বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. হাসানুজ্জামান, খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের অফিস তত্ত্বাবধায়ক বিজয় কুমার ঘোষ, নিম্নমান সহকারী মো. কলিমউদ্দিন নিজস্ব আলোকচিত্রি আতিক রহমান।

প্রতœসামগ্রী গ্রহণকালে মো. গোলাম ফেরদৌস বলেন, ঐতিহাসিক কালারাজা নামের স্থানটি দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাসে অত্যন্ত সুপরিচিত গুরুত্ববাহী। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান নিদর্শনের অভাবে এতদিন এর যথার্থতা প্রমাণিত হয়নি। মাটির তলায় পাওয়া প্রত্নবস্তুসমূহ প্রত্যক্ষ আলামত হিসেবে অঞ্চলের প্রাচীন জনবসতির প্রচলিত ধারণাকে পরিবর্তনের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ইতিহাস গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রাচীন এসব নিদর্শন পাওয়ার ঘটনা ভবিষ্যতে এখানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরীক্ষামূলক খনন অনুসন্ধানের পরিকল্পনাকে তরান্বিত করবে। অচিরেই অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কার্যক্রম শুরু করা হবে।

বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. হাসানুজ্জামান জানান, এসব প্রত্নসামগ্রী বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে।

কালারাজা গ্রামের মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা প্রত্নসামগ্রী প্রসঙ্গে গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মহিউদ্দিন আল হেলাল বলেন, এসব সামগ্রী প্রমাণ করছে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলে এক সময়ে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। প্রাকৃতিক মানবসৃষ্ট দুর্যোগে যা পরবর্তীতে পরিত্যক্ত ধ্বংস হয়। এক পর্যায়ে গহীন সুন্দরবনে রূপ নেয়। এসব প্রত্নসামগ্রীর সূত্র ধরে গলাচিপা উপজেলায় গুরিন্দা মসজিদ, দয়াময়ী মন্দির আনন্দময়ী মন্দিরসহ যে সব প্রাচীন স্থাপনা এখনো কোনোমতে টিকে আছে, সে সব জায়গায় অনুসন্ধান করা গেলে ইতিহাসের আরও অনেক উপাদান সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। যা আমাদের সমৃদ্ধ করবে এবং পূর্বসূরিদের সম্পর্কে জানা সহজ করবে।

ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দি ইউনিয়নের কমলাকান্ত নদের পাড়ের একটি গ্রাম কালারাজা। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতি। বর্তমান বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া, বাগেরহাটের পূর্বাংশ এবং পূর্বে মেঘনা তীরের জনপদ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য।

রাজা দনুজমর্দনদেব রায় ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দনুজমর্দন ছিল উপাধি। রানী কমলা সুন্দরী ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ষষ্ঠ উত্তরসূরি। তার বাবা জয়দেবের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। দুই বোনের মধ্যে সর্বাধিক যোগ্য কমলা ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের প্রথম শেষ নারী শাসক। রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার আগে বাবা জয়দেব জীবিত থাকা অবস্থায় কমলা দেবীর বিয়ে হয় বলভদ্র বসুর সঙ্গে। রাজা জয়দেব তার মেয়ে দেবী কমলা জামাই বলভদ্র বসুর বাসস্থানের জন্য কালারাজা গ্রামে বিশাল রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দেন। বলভদ্র বসুর গায়ের রঙ ছিল কালো। তাই তিনি মানুষের কাছেকালারাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কালক্রমে এলাকার নামও পাল্টে কালারাজা হয়। যদিও শিক্ষা, সমরবিদ্যা, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণসহ নানা গুণে কালারাজা ছিলেন গুণান্বিত।

রানী কমলা সুন্দরী দেবী তার স্বামী বলভদ্র বসুর সঙ্গে কালারাজা গ্রামের রাজপ্রাসাদেই অবস্থান করতেন। তার আশপাশে আরও বেশ কিছু স্থাপনা ছিল। যেখানে রাজ অমাত্যরা বাস করতেন। রানী কমলা প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট নিবারণে বর্তমান বাউফল উপজেলায় ১০০ একর জমি নিয়ে বিশাল দীঘি খনন করেন। যা এলাকায়কমলারানীর দীঘি হিসেবে আজো স্মৃতি বহন করছে। চন্দ্রদ্বীপ আমলে এভাবে দুই হাজারেরও বেশি দীঘি খনন করা হয়। কালারাজা বিলের রাজপ্রাসাদ দীঘিসহ সেসব দর্শনীয় স্থাপনার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সুনামি সে সব স্মৃতি বিলীন করে দিয়েছে। বিশেষত ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের ভূমিকম্প সুনামি ছিল সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী। ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে তৎকালীন আরাকান উপকূলে রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। যার প্রভাবে ঘটে সুনামি। এর তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে, আরাকান, চট্টগ্রাম বরিশাল অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বহু লোক মারা যায়। পরবর্তী ১৭ দিন পর্যন্ত ভূমিকম্পের আফটার শকড চলে।

এই ভূমিকম্প সুনামিতে কমলা রানীর রাজপ্রসাদসহ অন্যান্য স্থাপনা মাটির তলায় চলে যায়। পরবর্তীতে প্রথমে গহীন অরণ্য পরে বিলের সৃষ্টি হয়। উনিশ শতকের শুরুতে যখন কালারাজার বিলে বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠতে শুরু করে, তখন মাটি খুড়লেই মিলত প্রাচীন আমলের ইট।

অন্যদিকে, চন্দ্রদ্বীপ আমলের অসংখ্য স্মৃতিস্মারক বিলীন হয়ে গেলেও এতদাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখনো রাজকুমারী কমলাদেবীকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গান গল্প কবিতা পুঁথি প্রচলিত আছে। ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। আশার কথা মাটির তলা থেকে উঠে আসা প্রত্নসামগ্রী জানান দিচ্ছে, এখানেই ছিল একদা রানীর রাজপ্রসাদ। যা দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।

×