ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা

এনাম আনন্দ

প্রকাশিত: ০১:৪৫, ২৫ নভেম্বর ২০২২

ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা

.

দেশ-কাল-পাত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইতিহাস, সাহিত্যের ইতিহাসও তারই অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অতি নিবিড়। সাহিত্যের উৎস-জীবন। দেহের পুষ্টির জন্য যেমন খাদ্য প্রয়োজন, তেমনি মনের সুস্থতার জন্য সাহিত্যের প্রয়োজন। মানুষ সাহিত্যের পাঠক, মানুষই সাহিত্যের লেখক। ফলে জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক। নদীর মতো ইতিহাসের গতি কখনো ঋজু পথ ধরে চলে, কখনো বা ভুজঙ্গগতি। সাহিত্যের ইতিহাসের চরিত্রও সেই ধারা অবলম্বন করে বিবর্তিত হয়। হাজার বছর ধরে যে জীবনাদর্শ, আধিমানসিক স্বরূপ ও বিকাশলাভ করেছে তার শ্রেষ্ঠ প্রতীকের নাম বাংলা সাহিত্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলা সাহিত্যে যথার্থ আধুনিকতার সূচনা হয়। পূর্ববর্তী অর্ধে যার প্রস্তুতি ও প্রয়াস, দ্বিতীয়ার্ধে তার পূর্ণ বিকাশ। পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের সংঘাতে বাঙালির মনে যে জাগরণ শুরু হলো, তার প্রতিচ্ছায়া পড়েছে সমকালীন সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রর ব্যাপারে। জীবন সংগ্রামে ও কর্ম-ক্লান্তিতে মানুষ শিল্প-সাহিত্যর মধ্যে আশ্রয় চায়। জীবন মরুভূমির মধ্যে সাহিত্য মরূদ্যানের ভূমিকা পালন করে।
‘জীবনে যেমন বাস্তবের মূল্য আছে, তেমনি আছে কল্পনা ও আদর্শের গুরুত্ব। সাহিত্য ও জীবন ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সাহিত্যের মধ্যেও প্রতিফলিত হয় বাস্তব আর্দশ ও কল্পনার প্রতিমূর্ত।’ কবি ও সাহিত্যিকগণ কল্পনার আশ্রয়ে জগৎ জীবন পারিপাশির্^কের সুখ-দুঃখকে নিজের হৃদয়য়ানুভূতির সম্পৃক্ততা দ্বারা অনুভব করে নিজের ও সকলের হিত বা কল্যাণের সামগ্রী প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সামনে এখন বিরাট ভবিষ্যৎ নতুন নতুন সৃষ্টিসম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে ভবিষ্যতের অর্থ নিজ নিজ সত্তার সন্ধান, ব্যক্তিত্বের উন্মোচন। শিল্প-সাহিত্য ভাবমার্গেও শোভা-যাত্রার দান করে। আমাদের লেখক, পাঠক, শিল্পী ও প্রকাশক সকলেই নতুন প্রভাত আনার জন্য একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে চলছে নানা গবেষণা। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। আজ মানুষ এ বিশেষ জ্ঞানের সহায়তায় জীবনের সর্বস্তরে ও সর্বাবস্থায় রূপান্তর ঘটিয়ে চলছে। মানুষকে মানবিক চেতনা ও গুণে উন্নত করে প্রেরণা দিয়েছে উন্নত সমাজ গড়ার। যার ছোঁয়া লেগেছে অধুনিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও। ইন্টারনেট আধুনিক বিজ্ঞানের সেরকম একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। ইন্টারনেটের কারণে বদলে গিয়েছে আমাদের সাহিত্যচর্চার ধরন। যাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে সাহিত্যের শত শত লিটলম্যাগ, ওয়েবম্যাগ,ই-ম্যাগাজিন, ইপেপার ইত্যাদি।

সাহিত্যচর্চার নবদিগন্তের উন্মোচ করেছে ওয়েব পোর্টাল। বর্তমানে বাংলাদেশে শত শত সাহিত্যের ওয়েবসাইট রয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা পোষণ করলেই মুহূর্তের মধ্যে সার্চদিয়ে পড়ে নিতে পারছে তার প্রিয় লেখকের লেখা। কিন্তু দৈনিক যে এত এত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে তার মধ্যে কয়টি লেখা পড়ে পাঠকরা পাঠ তৃপ্ত হচ্ছে বা পাঠকের মনের খোরাক যোগাতে সক্ষম হচ্ছে সেটি এখন ভাবনার বিষয়। যেমন সাহিত্যচর্চার মাধ্যম বেড়েছে, তেমনি লেখকের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু মানসম্মত লেখা কী সে পরিমাণে বেড়েছে?
এক সময় একটি লেখা কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হতো এখন সে অপেক্ষা আর করতে হয় না। লেখা শেষ হওয়া মাত্র ইচ্ছা করলেই প্রকাশ করা যায়। কিছু কিছু সাহিত্যের ওয়েবসাইট ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখার মান বিচার করা হয় না। অনেক জায়গায় দেখা যায় বানান ভুল, বাক্যগঠনে ভুল, এমনকি লেখার শিরোনামেও ভুল বানান লক্ষ্য করা যায়। তারপরও  অনলাইন সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। প্রমথ চৌধুরী ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বলেছেন- সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দ দান করা। সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য হারায় স্বকীয়তা ও আকর্ষণ গুণ। তাই সাহিত্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ সাধন, মুক্তির পথ সৃষ্টি করা এবং আনন্দ দান করা। সাহিত্য সুনির্বাচিত এবং আমাদের মন গ্রহণযোগ্য হলে তবে তা পাঠ করার মধ্য দিয়েই আমরা জ্ঞান অর্জন করি। সৎ-সাহিত্য আমাদের সত্য উপলব্ধিতে সাহায্য করে, মানুষ্যত্বেও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটায়, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের বিচারে সহযোগিতা করে আমাদের প্রকৃত মুক্তি ও কল্যাণের পথে চালিত করে। আমরা নিশ্চই অবগত আছি যে, বিশে^র সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রয়ারি হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি কক্ষ থেকে বন্ধুদের ইন্টারনেটর মাধ্যমে সহজে যোগাযোগের কৌশল হিসেবে ফেসবুকের জন্ম। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় শত কোটির মতো মানুষ কোনো কোনোভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে।

আমাদের বাংলাদেশেই ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো। ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী নিজের আনন্দ-বেদনার অনুভূতি, ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতা ও ঘটনা, ছবি ইত্যাদি তার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। তাছাড়াও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতেও ফেসবুক একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। ভার্চুয়াল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও ফেসবুকের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ২০১২ সালের মাঝামাঝির দিকে কিছু সাহিত্যপ্রেমী মানুষের উদ্যেগে শুরু হয় ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয় ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চার গোড়াপত্তন। বর্তমান সময়ে অনেক নবীন লেখকের লেখালেখির হাতে খড়ি হয় এই ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চার সংগঠনগুলো থেকে। যার ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অনেক লেখক উঠে আসছে এবং মূলধারার সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা হচ্ছে অনেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের মতো। এখানে কেউ খেলাধুলা করে, কেউ দুষ্টুমি করে, কেউ বা গল্পে মশগুল থাকে, অনেক শিশুরা দলবলসহ মারামারিতে ব্যস্ত থাকে। ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চায় অধিকাংশ ব্যক্তিই অপক্ব, তাই এখানে অনেক ভুলত্রুটি হয়ে থাকে।
বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যায়- ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বিভিন্ন নামে বেনামে ফেসবুক সাহিত্য সংগঠন। সাধারণত যিনি ফেসবুক গ্রুপ ক্রিয়েট করেন তিনিই হন সংগঠনের প্রধান। গ্রুপের সাধারণ সদস্যদের তিনি ইনিয়েবিনিয়ে বুঝাতে থাকেন তিনিই হচ্ছেন দেশসেরা লেখক। তাই সাধারণ সদস্যদের অন্য কোথাও গিয়ে সাহিত্যচর্চা করতে নিষেধ করেন। ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চার কোনো কোনো সংগঠন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে ইচ্ছামতো অনৈতিকভাবে পদ-পদবি ও পদক বাণিজ্যর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের পকেট কমিটি করে উপদেষ্টা, সভাপতি, সহ-সভাপতি, পরিচালক অনেক প্রকার পদ তৈরি করে কোনো কোনো সাহিত্য সংগঠন ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকায় এসব পদ-পদবি বিক্রি করে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবসর প্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রবাসীরা এই পদগুলো কিনে থাকেন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও সম্মাননার নামে রমরমা পদক বাণিজ্যতো রয়েছেই। রয়েছে নানা নামের পুরস্কার যেমনÑ মাদার তেরেসা পুরস্কার, মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার, শেরে বাংলা পুরস্কার, নেলসন ম্যান্ডেলা পুরস্কার, মওলানা ভাসানী পুরস্কার, কবি রবীন্দ্র পুরস্কার, কবি নজরুল পুরস্কার, কবি জীবনান্দ পুরস্কার,পল্লী কবি জসীমউদ্দীন পুরস্কার ইত্যাদি। সংগঠনের প্রধানরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে তাদের কাছে পদ ও পদক বাণিজ্য করে (বিষয়গুলো এখন ওপেন সিক্রেট)।  অধিকাংশ ফেসবুক প্রুপ সাহিত্যচর্চার অনুষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশনের নামে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়ে প্রচুর টাকা আয় করে। সংগঠনগুলোতে উপাধি বাণিজ্যও বেশ রমরমা যেমন- কবি রত্ন, কাব্য রত্ন,সাহিত্য রত্ন,কবি স্রমাট, ছড়া সম্রাট, দ্রোহের কবি ইত্যাদি। উপাধি প্রাপ্তদের কখনো কখনো স্বর্ণের মেডেল বা রৌপর মেডেল দিয়ে বরণ করা হয়। উপাধি ও স্বর্ণ-রৌপ মেডেলের জন্য পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। উপাধি ও মেডেল প্রাপ্তদের সংবাদগুলো সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাদের মনোনীত কিছু মিডিয়া রয়েছে তাদের ম্যানেজ করে উপাধি ও পদকপ্রাপ্তদের ছবিসহ অনুষ্ঠানের সংবাদগুলো ফলাও করে প্রচার করা হয়।
অনেক সময় উপাধি প্রাপ্ত ব্যক্তিরা মিডিয়ার সংবাদগুলোকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করে। এই অনুষ্ঠানগুলোতে আমাদের দেশের অনেক পরিচিত মুখ কখনো প্রধান অতিথি কখনো প্রধান আলোচক হয়ে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের অতিথি করা হয়।
ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চার অনুষ্ঠানগুলোতে সাহিত্য নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হলেও নিজেদের প্রচারের আলোচনা ও সেল্ফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে। মেডেল নিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিলেই তেলেসমাতি কারবার সাঁতারকাটে লাইক ও কমেন্টের বন্যায়। অনেক পরিচিত কবি ও সাহিত্যিক এই অনুষ্ঠানগুলোতে যোগদান করেন কখনো বুঝে, কখনো না বুঝে, কখনো নিজের বইয়ের প্রচার করার উদ্দেশ্যে, কখনো অর্থের বিনিময়ে, কখনো বা স্বেচ্ছায়। তবে ভালো সংগঠনও রয়েছে। তারা সাহিত্যের জন্য ভালো কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা বিতর্কিত সময় পার করছে। তাছাড়াও সংগঠনগুলোতে যৌথগ্রন্থ প্রকাশ করার নামে এখানেও বাণিজ্য করে থাকে। এক শ জনের লেখা নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করলে লেখকদের কাছ থেকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত তারা নিয়ে থাকে। প্রতিটি যৌথগ্রন্থ থেকে হাজার হাজার টাকা বাণিজ্য করে সাধারণ সদস্যদের কাছে যার কোনো প্রকার হিসাব দিতে হয় না। এমন কী প্রতিষ্ঠাতা তার কমিটির কাছেও হিসাব দিতে বাধ্য নন।
সুতরাং সব মিলিয়ে বলা যায়- বাণিজ্যিকীকরণের পথে হাঁটছে ফেসবুক গ্রুপ সাহিতচর্চার সংগঠনগুলো। যা কখনো কাম্য নয়। ইতোমধ্যে অনেকেই ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং প্রতিদিন এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং এ সমস্ত অপকর্ম থেকে ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চার সংগঠগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই ফেসবুক গ্রুপ সাহিত্যচর্চা অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমাদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে নিহিত আছে বাঙালির ধ্যান-জ্ঞান ও সাধনা।

 

×