বড় কাটরার বাইরের অংশ (বামে ওপরে)
ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি বাঙালীর কী যে উদাসীনতা! হাজার বা শত শত বছর আগের স্মৃতি নিদর্শন সংরক্ষণে আহামরি কোন উদ্যোগ নেই। উল্টো দখলবাজরা গিলে ফেলার জন্য সবসময় মুখ হা করে রাখে। যত বড় স্থাপনা তত বড় হা। ফলে অনেক ঐতিহাসিক অমূল্য নিদর্শন নাই হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে বেশি শিক্ষিতদের ঢাকায় এ অপকর্মটি বেশি পরিমাণে হচ্ছে। একই কারণে ধ্বংস হচ্ছে বড় কাটরা ও ছোট কাটরা। বিগত দিনে মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন দুটির প্রতি চরম অযত্ন অবহেলা লক্ষ্য করা গেছে। সেই সঙ্গে চলেছে দখলদারিত্ব।
ধ্বংসপ্রায় মূল স্থাপনা আড়ালে চলে গিয়েছিল বহু আগেই। তার পর থেকে সময় সুযোগ বুঝে বিভিন্ন অংশ ভাঙ্গা হয়েছে। একইভাবে অতি সম্প্রতি আঘাত হানা হয়েছে বড় কাটরায়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার একাংশ সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েকদিন ধরে চলে এ অপকর্ম। যখন জানাজানি হয় তখন ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তার পরও ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রশংসা পেতে পারেন। এ জন্য যে, খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কর্মকর্তারাও সঙ্গে ছিলেন। সকলেই ধ্বংসলীলা দেখে হতবাক হয়ে যান।
সেদিনই ভাঙ্গার কাজ বন্ধ করে সংশ্লিষ্ট এলাকা সিলগালা করে দেয়া হয়। ফলে স্থাপনাটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যায়নি। বাইরে থেকে দৃশ্যমান কিছু অংশ এখনও টিকে আছে। টিকিয়ে রাখতে নতুন পরিকল্পনা নেয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন মেয়র। ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় সব সময় মাঠে থাকা সচেতন নাগরিকরাও বড় ও ছোট কাটরার স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন।
বড় কাটরা চকবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত। এটি ছিল সরাইখানা বা মুসাফিরখানা। প্রায় পৌনে ৪০০ বছর আগের নির্মাণ করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের তথ্য মতে, ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে মীর আবুল কাসেম এটি নির্মাণ করেন। মীর কাসেম ছিলেন মীর-ই-ইমারত। মানে, প্রধান স্থপতি। বলা হয়ে থাকে, বড় কাটরায় শাহ সুজার বসবাস করার কথা ছিল। পরে এটি সরাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কাটরায় ছিল দুটি শিলালেখা। একটি শিলা ফার্সী ভাষায় তুগরা আরবী রীতিতে লেখা। ১০৫৫ হিজরীতে, অর্থাৎ ১৫৪৬ সালে এটি লিখেছিলেন শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী। শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী, সুলতান শাহ্ সুজা সব সময় দান-খয়রাত করতেন। খোদার করুণা লাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক এই দালানটি নির্মাণ করলেন। এর সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হলো। যাতে এগুলোর আয়ে মূল স্থাপনার মেরামত কার্য চলতে পারে। এখানে মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। এ বিধি কখনও বাতিল করা যাবে না। বাতিল করলে অপরাধী শেষ বিচারের দিনে শাস্তি লাভ করবেন বলেও উল্লেখ করা হয় শিলালেখাতে।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন রেনেলের মানচিত্র দেখে বড় কাটরার মূল পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন। সে অনুযায়ী, বড় কাটরার মাঝখানে ছিল খোলা প্রাঙ্গণ। এর চারদিকে চকমিলান ইমারত দিয়ে ঘেরা ছিল। মূল প্রবেশদ্বার ছিল উত্তর ও দক্ষিণে। দক্ষিণের অংশটি ছিল নদীর দিকে, পূর্ব পশ্চিমে ২২৩ ফুট লম্বা। এ অংশের মাঝামাঝি স্থানে ছিল তিনতলা উঁচু ফটক। তার দুপাশে দুতলা ঘরের সারি। একেবারে দুপ্রান্তে আটকোনা দুটি বুরুজ।
চুনসুরকি দিয়ে মজবুত করে নির্মিত হয়েছিল অট্টালিকা। তখন ঢাকা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। নদীপথে বা স্থলপথে বণিকরা এখানে আসতেন। তাদের অনেকেই বিশ্রাম নিতেন বড় কাটরায়।
ধারণা করা হয় রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে বড় কাটরা অবহেলার শিকার হতে থাকে। ক্রমে পরিত্যক্ত স্থাপনায় পরিণত হয়। শুরু হয় দখলদারিত্ব। বড় কাটরার বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে চারপাশে নতুন স্থাপনা নির্মিত হতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ঐতিহ্য স্মারকের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে একটি মাদ্রাসা। দখলদারদের কেউ কেউ আবার কাগজপত্র দেখাচ্ছেন। দাবি করছেন, এটা তারা কিনে নিয়েছেন! সর্বশেষ যে ব্যক্তিটি ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছেন তিনিও একই দাবি করেছেন। প্রশাসনের একটি অংশও এ ধরনের অবৈধ কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত। এ অবস্থায় কোন রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে মুঘল নিদর্শন। এখন বড় কাটরা আসলে বড় কাটরার স্মৃতিচিহ্ন।
ছোট কাটরার অবস্থা আরও খারাপ। একটি সরু গলির ওপর বিশাল এক তোরণ কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। এটিই আপাতত ছোট কাটরা। চারপাশে দোকান। নতুন নতুন স্থাপনা। এসবের মধ্য থেকে তোরণটিকে খুঁজে নিতে হয়। বড় কাটরার কাছে, পূর্ব দিকে এর অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুবেদার হয়ে আসার পর শায়েস্তা খাঁ ছোট কাটরার নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। সাল ১৬৬৩ বা ১৬৬৪। যতীন্দ্রনাথের মতে, নির্মাণ শেষ হয় ১৬৭১ সালে। বড় কাটরার সঙ্গে ছোট কাটরার মিল ছিল যথেষ্ট। তবে আকারে এটা কিছুটা কম ছিল। তাই ছোট কাটরা নাম।
মুনতাসীর মামুনের মতে, ছোট কাটরাও ছিল সরাইখানা অথবা এটি প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতোঝ। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে ছোট কাটরায় ঢাকার প্রথম ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা ছিল ঢাকার নবাব পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ছোট কাটরার চত্বরেই ছিল বিবি চম্পার সমাধি। কিছু ধ্বংস হয়েছে। কিছু গিলে খেয়েছে দখলবাজরা। এর পরও, হ্যাঁ, স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে তোরণটি। যেটুকু আছে সেটুকু দেখেই অভিভূত হতে হয়। মুঘল স্থাপত্যের সেই ঝিলিক টের পাওয়া যায়। ঝিলিকটুকু ধরে রাখলেও কিছু থেকে যাবে, নিশ্চিত।
এ প্রসঙ্গে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলামের বক্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক। গত জুলাই মাসের একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, রায় সাহেব বাজার সংলগ্ন এলাকায় সবার চোখের সামনে প্রায় ১১৫ বছরের পুরনো নিলাম ঘরটি ভেঙ্গে ফেলা হলো। আইনজীবীরা এই অন্যায় কাজটি করেছেন। এখন সেখানে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ।
আমরা প্রতিবাদ করলেও সরকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর প্রশাসন বা পুলিশ কেউ সেদিন এগিয়ে আসেনি এবং ওই ঘটনা দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েই বড় কাটরায় সম্প্রতি ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে বলে আমি মনে করি। যিনি বড় কাটরার আরেকটি অংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তিনিও ভেবেছিলেন পার পেয়ে যাবেন। এবার হয়ত পুরোপুরি সফল হননি তিনি। তার পরও হয়ত চেষ্টা চালাবেন।
শেখ ফজলে নূর তাপসের উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মেয়র ঢাকা দক্ষিণের ঐতিহ্য রক্ষায় বড় পরিকল্পনা নিচ্ছেন বলে শুনেছি। এটা প্রশংসার দাবি রাখে।
কারণ এ ধরনের পুরাকীর্তি আমাদের অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। উন্নত বিশ্বে যত প্রাচীন স্থাপনাই হোক না কেন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অগ্রগতির এ যুগে এটা সম্ভব। আগামী প্রজন্মকে ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে বড় কাটরা ও ছোট কাটরাসহ সব ধরনের পুরাকীর্তি এক টুকরো হলেও তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন এই আন্দোলনকারী।