একুশে ফেব্রুয়ারি। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তায় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল তা ছিল এক অবিনাশী চেতনা। একুশ আমাদের জোগায় অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি ও প্রেরণা।
একুশের চেতনার জন্ম হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। প্রায় দুই শ’বছর ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গোটা ভারতবর্ষকে দুই ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব হাজার মাইলের অধিক হওয়া সত্ত্বেও জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আমাদের জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। তখন তাদের মাথায় চেপে বসে ক্ষমতা দখলের ভূত। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করলে নাকচ করে দেয়া হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার সামনে যখন বেশ জোরালো ভাষায় বলেন, ‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে।’ তখন উপস্থিত জনতা এর প্রতিবাদ জানায়। এসব তোয়াক্কা না করে জিন্নাহ ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথা বলেন। কার্জন হলে উপস্থিত কিছুসংখ্যক ছাত্র তখনই ‘নো নো’ বলে প্রতিবাদ করে ওঠে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধূমায়িত হয়ে থাকে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ। ১৯৪৯-১৯৫১ এর মধ্যে ক্রমে জোরালো হয়ে ওঠে ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি, হয়ে ওঠে বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ইস্যু।
১৯৫২ সালের শুরুতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসেন। তিনি ২৬ জানুয়ারি এক জনসভায় জিন্নাহর বিবৃতির পুনরাবৃত্তি করেন। এর প্রতিবাদে এই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৯৫২) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এতে ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীত হয়ে পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ১৪৪ ধারা জারি করে সকল প্রকার মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে রুখে রাখতে পারেনি তারা। ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত প্রমুখ। শহীদ হন অহীউল্লাহও। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সারাবাংলা। পরদিন সারারাত জেগে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। পুলিশ তা ভেঙ্গে ফেললেও পরবর্তীতে আবার গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। এ শহীদ মিনার শোক, সংগ্রাম ও শপথের প্রতীক। তা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতি চেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে।
১৯৫২ সালের সেই রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালীর জাতিসত্তায় যে চেতনার উদ্ভব হয়েছিল সেটি আমাদের যুগ যুগ ধরে দিয়ে আসছে শক্তি ও প্রেরণা। এই চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। পরে প্রতিটি গণআন্দোলনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে ভাষা আন্দোলন, দিয়ে আসছে আমাদের প্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহির্প্রকাশ ঘটেছিল। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালীর যে আত্মসচেতনতা ও আত্মপরিচয়ের উদ্বোধন ঘটেছিল তার পথ ধরে ’৫৪ এর নির্বাচন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১ এ আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি নানা সঙ্কট। মুক্তিযুদ্ধের ভাববীজ আমরা পেয়েছি ভাষা আন্দোলন থেকে।
বাঙালীদের সেদিনের আত্মদান শুধু ভাষা অধিকার আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বপ্ন ও অঙ্গীকারে দানা রেখেছে। সে স্বপ্নই স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের দিয়েছে প্রেরণা, দেখিয়েছে পথ। তারপর আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি; দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো ৩১তম অধিবেশনে ভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে ১৮৮টি দেশে সর্বপ্রথম পালিত হয় এদিনটি। বর্তমানে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা।
একুশ আমাদের অহঙ্কার। একুশ আমাদের প্রেরণার উৎস। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল। একুশের অবিনাশী চেতনা আমাদের দেয় প্রেরণা, করে উজ্জীবিত। এই প্রেরণা অম্লান রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়