ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

পাক-ভারত ‘ফ্ল্যাগ মিটিং! ॥ ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

পাক-ভারত ‘ফ্ল্যাগ মিটিং! ॥ ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। এদিন বাংলাদেশের দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা মুক্তিসেনাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল একাত্তরের রণাঙ্গনে। পাকিস্তানী জঙ্গীবাদী ও গণহত্যাকারীরা গ্রামে-গঞ্জে দ্রুতগতিতে পৌঁছুতে পারেনি। অন্যদিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানকারী বাংলাদেশী মুক্তিকামী সৈনিকরা পাল্টা আক্রমণের জন্য সঠিক স্থানের অনুসন্ধান এবং সীমান্তের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অভিযান চালাতে সুযোগ পেয়েছিলেন। এই দিন ভারতের হিলিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়। পাকহানাদার বাহিনী সড়কপথে মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করে। শহরে ঢুকেই কালবিলম্ব না করে স্থানীয় দোসরদের সহযোগিতায় এমপি আসমত আলী খান ও ফনীভূষণ মজুমদারের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং বহু বাড়িসহ দোকানপাট লুট করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট, বাঙালীপুর, টিয়রপাড়া ও মধুপুরে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি চলে। এ সমস্ত ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ১ মাস ১৫ দিন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ‘ফ্ল্যাগ মিটিং’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাকিস্তানীরা বারবার ইপিআর বাহিনীকে তাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু ভারতীয় বিএসএফের মেজর বেদী, ক্যাপ্টেন ঘোষ ইপিআর সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান। পাকিস্তানী সেনারা চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী সেনাক্যাম্পে একত্রিত হয়ে সাতকানিয়া থানার কাঞ্চনা গ্রামে আক্রমণ করে। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালায়, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। জ্ঞানের আলো জ্বালাতে শিক্ষানুরাগী রায় সাহেব কামিনী কুমার ঘোষের গড়া ইনস্টিটিউটে প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ভূরুঙ্গামারী সোনাহাট হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। পাশাপাশি ভূরুঙ্গামারী থানা সদরেও একটি প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। পাকবাহিনী ফরিদপুর দখল করার পর ২৪ এপ্রিল মাদারীপুর আক্রমণ করে। পাকবাহিনী মাদারীপুরের এসডিও (ঝঁন-উরারংরড়হধষ ঙভভরপবৎ) রেজাউল হায়াত, সেকেন্ড অফিসার আবদুল হাই, কালকিনি থানার সিও ডেভ (ঈরৎপষব ঙভভরপবৎ-উবাবষড়ঢ়সবহঃ) এন এম মাহবুবকে গ্রেফতার করে তাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়। রাঙামাটি থেকে মহালছড়ি আসতে পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্যের সঙ্গে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের ও লে. মাহফুজের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের কুতুবছড়ি নামক স্থানে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি হয়। পাকবাহিনীর একদল সৈন্য চিংড়ি নদী দিয়ে নানিয়ারচর বাজার হয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পুলিশ সুপার নূরুল মোমিন খান (মিহির) ফরিদপুর পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে দেন। ফরিদপুরে মুক্তিবাহিনীর জন্য এটাই প্রথম অস্ত্র লাভ। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে করেরহাট নামক স্থানে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে পাকসেনাদের প্রতিহত করেন। এদিন প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকরের কাছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে স্বাধীনতা ঘোষণা, সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকলেও কোন রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কথা উল্লেখ ছিল না। ভারত সরকার এ আবেদনে কোন সাড়া দেয়নি। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শ্রমিকদলের সদস্য উড্রো ওয়াট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক হত্যার প্রতিবাদে আমরা সবাই এত চুপচাপ কেন? পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত জঘন্য। হিটলার ও স্ট্যালিনের পর এ ধরনের হত্যাকা-ের কথা আর কখনো শোনা যায়নি। আমরা এ বিষয়ে কি করছি? জেনারেল ইয়াহিয়াকে এখনও আমরা সাহায্য দিচ্ছি। সারাদেশ উজাড় করার বিষয়টি মোটেই ঘরোয়া ব্যাপার নয়। ঢাকার মিরপুরে দেওয়ান ওয়ারেসাত হোসেন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় মোঃ সামীউদ্দিন খানকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট ‘শান্তি কমিটি’ গঠিত হয়। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন ‘কেন্দ্রীয় শান্তি’ কমিটির আবুল কাসেম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, মেজর আফসারউদ্দিন প্রমুখ। শান্তি কমিটির ১৮টি ইউনিট আহ্বায়কের নাম ঘোষণা করা হয়। আহ্বায়করা হচ্ছেন- তেজগাঁও (পূর্ব) মোঃ ফজলুর রহমান, ধানমণ্ডি, এসএম হাবিবুল হক, নারায়ণগঞ্জ (শহর) - এএসআই সরদার, দিলখুশা- মোঃ মনসুর আলী, জোয়ার সাহারা- আলী আহসান, শরাফতগঞ্জ- গিয়াসউদ্দিন আহমদ, খিলগাঁও- ড. আইয়ূব আলী, নবীনগর (কুমিল্লা)- মৌলবী সেকেন্দার আলী, জয়দেবপুর - আবদুল মজিদ সরকার, জয়দেবপুর (থানা)- মোঃ মস্তান খান, রেকাবীবাজার- ইদ্রিস বেপারী, মোহাম্মদপুর- দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী, দিলু রোড- জিআন, নিউ ইস্কাটন- মজিবুর রহমান, ধানমণ্ডি (পূর্ব)- এমএ খালেক, মহাখালী- একেএম আবদুল্লাহ, মিরপুর- মো. শফিউদ্দিন খান ও শাজাহানপুর- এম এ খালেক। সরকারী এক হ্যান্ড আউটে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররমসহ সমস্ত জায়গায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। প্রদেশের সর্বত্র সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে যথারীতি কাজ চলছে। সব ব্যাপারেই জনগণ সহায়তা করছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা থেকে দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদ করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করায় জনগণের মধ্যে পুরোমাত্রায় আস্থা ফিরে এসেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×