ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

সুফিয়া কামালের প্রকৃতি নিমগ্নতা

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

সুফিয়া কামালের প্রকৃতি নিমগ্নতা

কবি সুফিয়া কামালের কাব্য সৃষ্টির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে প্রকৃতি নিমগ্নতা। প্রকৃতির নানা রূপ, পরিবর্তন, আবর্তন, ফুল, ফসল, নদী, মেঘ, জল, বৃষ্টি তার কবিতায় এসে জীবন্ত হয়ে ওঠে; তারা যেন প্রাণসত্তা লাভ করে। কবির ভাবনা চিন্তা, অনুভব, অনুভূতিতে প্রকৃতি জড়িয়ে যায় প্রাণরুপি সত্তা নিয়ে। ইংল্যান্ডের কবি জন কীটস যেমন প্রকৃতির ভেতর দিয়ে নতুন জীবন দর্শন লাভ করেন কবি সুফিয়া কামালও প্রকৃতিতে জীবনের বিশেষ তাৎপর্য খুঁজে পান। সুফিয়া কামালের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, মান, অভিমান, অনুরাগ প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে আরও গভীরতা লাভ করে। তার হারানোর যে বেদনা, তিনি প্রকৃতিকে কখনও আলিঙ্গন করে আবার কখনও দূরে ঠেলে দিয়ে প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে প্রকৃতির সঙ্গে তার জীবনের বেদনা ও সুখময়তার উপলব্ধি একাকার হয়ে যায়। সুফিয়া কামালের কাব্যে প্রকৃতিতে কখনও আরোপিত হয়েছে মানবত্ব, কখনও তা রূপকাশ্রয়ী ও অনুভূতিপ্রবণ, কখনও তাকে দেখা হয়েছে বন্ধুর মতো অন্তরঙ্গতায়। প্রকৃতির আয়নায় কবি যে নিজেকে খুঁজে পান তা সত্যিকারের ব্যক্তি সুফিয়া কামাল- যিনি প্রকৃতি কাঁদলে কাঁদেন- ফুল ফুটলে আনন্দে মুখরিত হন; আবার কখনও কাছের প্রিয়ার মতো অভিমানে প্রকৃতির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রকৃতির নিরন্তর বহমানতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এভাবেই ব্যক্তি সুফিয়া কামালে উন্মেষ ঘটে। এ ব্যাপারে কবি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। সুফিয়া কামাল নারী জাগরণের আলোক বর্তিকা নিয়ে এবং নারীর অধিকার আদায়ে শুধু তাত্ত্বিকভাবে নয় নানা কর্মসূচী ও সমাজ সেবার মাধ্যমে নারীর সর্বস্তরে স্বাধীনতার জন্য সফল সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু এই উল্লেখযোগ্য কীর্তির পাশাপাশি তার কবিতায় প্রকৃতি প্রেম এসেছে রোমান্টিক কবিদের মতোই- রোমান্টিক ভাবপ্রবণতা সুফিয়া কামালের কাব্যিক সৌন্দর্যের মৌলিক দিক। সুফিয়া কামাল তার কাব্য সাধনার প্রথম দিকে ভীষণভাবে একাকীত্বে ভুগেছেন। কাব্যচর্চা ও শিল্পের আশ্রয়ে তিনি একজন জীবনমুখী কবির মতোই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তার দাম্পত্য বেদনাকে। আত্মগত যন্ত্রণা ও বেদনাকে তিনি শিল্পিত ভঙ্গিতে রূপক, প্রতীক, উপমার দ্বারা কবিতার শব্দমালায় রূপান্তরিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায় রচিত করে গেছেন। প্রকৃতিকে রূপ-মাধুর্য দান করে কবি একাত্ম হয়ে যান এই নান্দনিক জগতে। এক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল গবেষক ইয়াসমিন সুলতানা বলেন- কবি তার আপন পরিবেশের সঙ্গে কল্পনার রং মিশিয়ে নিগূঢ়বন্ধন তৈরি করেন কবিতায়। কবিতায় নির্মাণ করেন প্রকৃতির বহু বর্ণিল রূপ। কবির মনোভাব, সঞ্জীবিত প্রকৃতিচিত্র আধুনিক সাহিত্যে বিচিত্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সুফিয়া কামালের জন্ম বরিশালের নদী-বিধৌত প্রাকৃতিক পরিবেশে ১৯১১ সালের ২০ জুন, শায়েস্তাবাদে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বরিশালের নদী-বিধৌত অঞ্চল আর সবুজ অরণ্যময় প্রকৃতির রূপে বিমুগ্ধ কবি আশ্রয় নেন প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে। তার মানস লোকে ছিল প্রকৃতির অবাধ বিচরণ। কবিতায় কবি প্রেম-বিরহ-বেদনার বর্ণনা ও প্রকৃতির নিবিড়তাকে নান্দনিকভাবে প্রকাশ করেছেন। ইয়াসমিন সুলতানার মতে নিসর্গের মাধুর্যকে সুফিয়া কামাল নিজ পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে আহরণ করেছিলেন। সেই উপলব্ধিগত অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছেন। আগেই বলা হয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে বহুমাত্রিক রূপ দিয়েছেন। বাংলা কাব্যে পল্লীপ্রকৃতির এই পরিণত ধারায় রবীন্দ্র পরবর্তী যে কবিরা প্রভাবিত হন; তাঁদের মধ্যে সুফিয়া কামাল অন্যতম। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ তার মনে অনেক বেশি প্রভাব ফেলেন। সেই সঙ্গে পল্লী বাংলার রূপ মাধুর্যে লালিত সুফিয়া কামালের কবিতায় উদার প্রকৃতির সম্মোহনী রূপ তার কাব্য-অস্তিত্বকে বিকশিত করেছে। তার কাব্য চেতনায় ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্যান্থেয়িজম, শেলীর আকাশচারি কল্পনা, কীটসের সৌন্দর্যানুভূতি খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনানন্দের বিষাদময়তা ও প্রকৃতি নিষ্ঠতা কবিকে স্পর্শ করে। যে কথা বলা হয়েছে- সুফিয়া কামাল নিসর্গের এই আকাশ চারিতায় বিচরণ করে প্রেম ও বিরহ-বেদনাকে প্রকৃতির নিবিড়তায় একাত্ম করে দিয়েছেন। সুফিয়া কামালের প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থগুলো প্রকৃতি প্রেমে ঋদ্ধ। তার মধ্যে ‘সাঁঝের মায়া’, ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’ , ‘উদাত্ত পৃথিবী’, ও ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ উল্লেখযোগ্য। এসব কাব্যগ্রন্থের অসংখ্য কবিতায় কবি প্রকৃতির নান্দনিকতাকে নিজের করে নিয়েছেন ডুব দিয়েছেন প্রকৃতির সুন্দরে- জীবনের যত তুচ্ছতাকে কবি সরিয়ে রাখেন অপরূপ প্রকৃতিতে অবগাহন করে। তার কবিতায় বাংলার অতুলনীয় প্রকৃতির রূপ মাধুর্য নিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে; যা বর্তমানের ক্ষয়ে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে এক বিরাট বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। সুফিয়া কামালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। কবি এই কাব্যের নাম দিয়েছেন প্রকৃতির মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন থেকে। দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণে যে সময়টুকু, সেই সময়কে তিনি কাব্যরূপ দান করেছেন। এখানে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ কবিতায় জীবনানন্দের মৃত্যু চিন্তার চিহ্ন মেলে- ‘নিশীথের সুপ্তি ভাঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে ভয়ে অবিশ্বাসে। তারও পরে আসে সেই দিন মৃতের কঙ্কাল পরে জেগে ওঠে জীবন নবীন।’ কবি এখানে জীবন ও মৃত্যুকে পাশাপাশি রেখে জীবনকে খোঁজার তাড়না দেখান। তিনি হারিয়ে যাওয়া সময়ের নিঃসীমতা থেকে মহাত্মাদের সন্ধান পান; বিষাদ কবি মনকে ছুঁয়ে যায় এই কবিতাতেও কবি শুধু বিচলিত নন কালের অবক্ষয়ে তার প্রাণপ্রিয় সঙ্গীনি তার স্বামীকে স্মরণ সুধায় পেতে চান শিল্পের আশ্রয়ে আবার সাঁঝের মায়ায় কবি দেখেন অস্তাচলে যাওয়া সূর্য আদও চুম্বন দিয়ে যায় রক্তিম প্রকৃতিকে। যার মায়ায় কবি মুগ্ধ হয়ে মুক্তি লাভও করেন- ‘সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজেন’। ‘নববর্ষে’ কবিতায় অতিতকে মুছে ফেলে অস্তাচলে যাওয়া সূর্য থেকে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকেন। এভাবে কবি কখনও সুখ কখনও দুঃখ এই দুই অনিবার্য সত্যের মাঝে যাতায়াত করেন। নতুন আশায় কবির মনে জাগে কর্মময় জীবনের স্পন্দন। ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থে কবি প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেন। পল্লী বাংলার শ্যামল সুন্দর রূপ ও ষড়ঋতুর উদারতা কবি উপলব্ধি করেন হৃদয় থেকে গভীরভাবে। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যে কবির কবিতায় অমর হয়ে আছে; ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেমন ইংল্যান্ডের বিস্ময়ভরা প্রকৃতির অবাক দর্শক সুফিয়া কামালও তেমনি। বাংলার প্রকৃতির এই মুগ্ধতা কবিকে প্রকৃতির অনিবার্য অংশ করে তোলে; কবি হয়ে যান প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তাই কবি ঝড়ের রুদ্র রূপের মাঝে দেখেন সুন্দর প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকা অসুন্দর যেমনটা উইরিয়াম ব্লেক দেখেন সুন্দর গোলাপের মাঝে কীটের দংশনে। ‘ঝড়ের আগে’ কবিতায় বৈশাখী ঝড়ের যে রুদ্রমূর্তি তা কবিকে অন্দোলিত করে ভীষণ। ব্লেক যেমন ‘ল্যাম্ব’ ও ‘টাইগার’ দুটি কবিতা দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির দুটি বিপরীত কিন্তু অনিবার্য মহিমা তুলে ধরেন সুফিয়া কামালও তাই: ‘হেরিনু সুন্দর’ পরে অসুন্দর অসুর পীড়ন কোমল কঠোর নিষ্পেষণ! সুন্দরে ভীষণে দ্বন্দ্ব হেরিলাম অপূর্ব বিলাস সৃষ্টি সনে হেরিলাম স্রষ্ঠার অনন্ত পরিহাস!’ ব্লেক যেমন ‘ ল্যাম্ব’ ও ‘টাইগার’ দুটি কবিতা দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির দুটি বিপরীত কিন্তু অনিবার্য মহিমা তুলে ধরেন সুফিয়া কামালও তাই। বৈশাখের তপ্ত খরতাপের পরে আসে বর্ষা। বর্ষার নতুন জল ধারায় প্রাণে জাগে স্পন্দন। সজীবতায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ব-ব্রহ্মা-। ঝড়ের রুদ্রমূর্তির পরে সরস বর্ষার যে রূপের সন্ধান মেলে, তা কবির ‘ঝড়ের শেষে’ কবিতায় উঠে এসেছে : ‘মধুর মমতা ধারা বিথারিয়া আর্দ্র সমীরণে ভুলিয়া বেদনা জ্বালা শুচিস্মিতা প্রশান্ত আননে চাহিয়াছে ঊর্ধ্বমুখী সুকল্যাণী ঝঞ্ঝা বিশেষে যত ক্ষতি যত ব্যথা ভুলাইয়া ভুলিয়া নিঃশেষে।’ ইয়সমিন সুলতানা ‘বর্ষার প্রতীক্ষা’ কবিতার ব্যাপারে বলেন, কবি এই কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ষার জলধারাকে কবি প্রিয়ার অভিমানিত অশ্রুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয়া এলায়িত ঘনকেশে দিগন্তের দিকে চেয়ে চেয়ে প্রিয়ের জন্য অপেক্ষা ও অশ্রু বিসর্জন করে। গ্রীষ্মের তপ্তরোদে বর্ষা তার ঘন মেঘ নিয়ে বর্ষণের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর এক সময় তা ধরণীর বুকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। ‘সুন্দরী বসুধা’ কবিতায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের অনিন্দ্য বর্ণনা মেলে; রৌদ্র, সাগর, মরু, ফুল, পাখি, চাঁদ, নিশীথ, মাটি, ধূলিকণা সবগুলোকে বুকে নিয়ে পৃথিবীর যে অক্লান্ত চলা কবি তাই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন এই কবিতায় : ‘শেষ দিবসের পাত্র ভরি সাকী আনিয়াছে সুধা করো পান, করো স্নান সর্বংসহা সুন্দরী বসুধা’ ‘অকাল মেঘ’ কবিতায় কবি বৃষ্টিকে নিজের করে নেন। ‘ও যেন এসেছে আমার মনের আকাশে পথ বেয়ে/মেঘরূপা হয়ে আমার নয়ন ছেয়ে!’ আবার তৃষিত হৃদয়ে শ্রাবণের জলধারার স্পর্শে শুধু কবি মন নয় কবি জানেন প্রকৃতিও জেগে ওঠে। জীবনের সকল অবসাদ বিরহ-বেদনা বর্ষার জলধারা সব মুছে দেয়। আনন্দের আধিক্য প্রকাশ কখনও কখনও বিষাদের মনে হয়। কেননা যখন শ্রাবণ ধারার স্পর্শে কদমে শিহরণ জাগে, কেয়াকে কণ্টকাঘাতের বক্ষ ভেদ করে ফুটতে হয়। মেঘের ডাকে তৃষিত চাতক কেঁদে ওঠে, আর প্রিয়ার প্রবাসে প্রিয়ের কথা সব মনে পড়ে যায়। পাওয়ার আনন্দের প্রতীক্ষা যে বড় কষ্টের; তা কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন আবার ‘শ্রাবণ’ কবিতায়। বাংলার প্রকৃতি রূপ বৈচিত্র্যে ভরা তাই কবি সুফিয়া কামাল একে একে সকল ঋতুকে স্মরণ করেছেন। ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে প্রকৃতির সাজের পরিবর্তন ঘটে। কবি চিত্রশিল্পীর মতো ঋতুগুলোর সেই রূপ তার ‘শরত আবার যেদিন আসিবে’ কবিতায় তুলে ধরেছেন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, শীত ও বসন্ত- এসব ঋতু তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে সুনিপুণভাবে কবিতার পঙ্ক্তিতে নিজেদের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। শরত এর বিদায়ের সঙ্গে তার আয়োজনকে কবি স্মরণ করেছেন। যার আগমনে সিন্ধুতে জল আসে, রেণুতে পথের ধূলি ঢাকা পড়ে, নিশিগন্ধারা আবার জেগে ওঠে। কবির কাছে নিশিগন্ধার জেগে ওঠা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে; সকালে ক্ষণিক সময়ের জন্য ফুটে ঝরে গেলেও কবির তাতে দুঃখ নেই; রবার্ট হ্যারিকের ‘টু ড্যাফেডিল’ এর মতো। কারণ আসল আনন্দ হচ্ছে আনন্দকে ধরে রাখার চেষ্টা পেয়ে গেলে তাতে আর আনন্দ থাকে না। যৌবনে মানুষ যেমন প্রাণচাঞ্চল্যে কর্ম-কোলাহলে মুখরিত থাকে; শরতকালে প্রকৃতিও সেই রূপ লাভ করে। প্রিয়া বিচ্ছেদে যেমন মানুষ কাতর হয় শরত চলে গেলে প্রকৃতিও তেমনি হয় এটি কবি ‘শরত আবার যেদিন আসিবে’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। শরত বিদায় আর প্রিয়ের নিকট থেকে বহুদূরে চলে যাওয়ার স্মৃতিকে কবি এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘সেই সুন্দর শরত আবার যেদিন আসিবে ফিরে, মনে করো সখি! মিলন নিশীথে এই তব সাথীটিরে।’ মানব মনের অনুভূতিগুলোকে প্রকৃতি খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করে; আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সুদূর অতিত থেকে প্রকৃতির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। শরতের পর হেমন্তের আগমন ঘটে। সুফিয়া কামাল জন কীটস ও রবীন্দ্রনাথের মতো হেমন্তকে করেছেন অপার মহিমায় গৌরবান্বিত। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুমাস হেমন্তকাল। কার্তিক মাসে তার পদচারণা শুরু হলেও; অগ্রহায়ণে প্রকৃতি রূপসী বাংলার মাটির মানুষের কাছে তার যে উপহার দান করে, তার বর্ণনা পাওয়া যায় ‘অগ্রাণী সওগাত’ কবিতায়। অগ্রহায়ণ প্রধান আকর্ষণের সোনার ফসল, যা কৃষকের ঘরে, মাঠে, পথে, প্রান্তরে ছড়াছড়ি করে। তখন পুরনো দিনের সমস্ত বেদনা ভুলে পল্লীর মানুষের মনে আসে আনন্দের বন্যা। ‘হেমন্ত’ নামক বিখ্যাত কবিতায় কবি হেমন্তের পরিপূর্ণ ও সুডৌল রূপ অঙ্কন করেন : ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে কোন্ পাথারের ওপার থেকে আনলে ডেকে হেমন্তকে? আনল ডেকে মটরশুঁটি, খেসারি আর কলাই ফুলে আনল ডেকে কুয়াশাকে সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।’ এই কবিতাটি জন কীটসের ‘ওড টু ওটম’ কবিতাকে মনে করিয়ে দেয়। স্বপ্নচারি কীটস হেমন্তের রূপ দেখে আকাশচারিতা থেকে মাটির সুন্দর পৃথিবীতে নেমে আসেন আপ্লুত মনে আবার ‘হেমন্ত’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের গান ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা’ শরত ও হেমন্তকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই গানটির সঙ্গে অন্তঃকরণে মিলে যায়। সুফিয়া কামালের ‘পঊষ’ কবিতায় আগামীর সুখবার্তা পাওয় যায়। এই রিক্ত ফুলহীন দিনেও কবি চারদিকে শোনেন আগামী দিনের প্রত্যাশা : ব্যর্থতার হা-হা ধ্বনি শূন্যভরি মর্মরিয়া বাজে। নামিছে সুদীর্ঘ রাত্রি চন্দ্রজ্যোতি কুয়াশা মলিন শীতার্ত প্রহরগুলো ক্লান্তিকর পুষ্প সঙ্গীহীন, শীর্ণ শুষ্কলতা আনত ধরণী পরে শুনিতেছি কোন সে বারতা! মৃত্তিকার বক্ষে জাগে ভাষা পরম স্থৈর্যে করে তরুলতা মাঘের প্রত্যাশা। কবিতাটি আমাদের শেলীর ‘ওড টু ওয়েস্ট উইন্ড’ এর কথা মনে করিয়ে দেয়। শেলী যেমন বিখ্যাত উক্তিতে বলেন ‘ যদি শীত চলে আসে/বসন্তও আসবে, থাকে তার পাশে পাশে।’ শীতের শেষ ও বসন্তের সুখবর নিয়ে উপস্থিত হয় ‘মাঘের মমতা’ এখানেও কবির সঙ্গে শেলীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ‘ চলে যায় শীত। আসে মাঘের মমতা ভরা কোলে পথ ভোলা শিশু- ফাগুন, হাওয়ায় যেন দোলে।’ বসন্ত কখনও রোমান্টিক ভাবাবেগে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়েছে; কখনও তার রূপ মাধুর্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। বসন্ত ঋতুর বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, বিচিত্রতা ও বিষয়-প্রকরণ নিয়ে সুফিয়া কামাল অনেক কবিতা রচনা করেছেন। ‘ব্যর্থ বসন্ত’, ‘বসন্তের সব আয়োজনকে একত্রিত করে রচিত হয়েছে ‘চৈত্র-পূর্ণিমার রাত্রি’। কিন্তু সে সৌন্দর্যে জাগরণ নেই, আছে আয়োজনের সঙ্গে সংশয়-শঙ্কা। যেখানে কোকিলের গুঞ্জন থেমে যায়, চকোরের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, মালতীর বক্ষ শিউরে ওঠে, চাঁদ থেমে যায়। সুফিয়া কামালের কবিতায় হৃদয় বেদনা সবখানে একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো মনে হয়- এমনকি প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনাতেও একটা চাপা বেদনার সুর মর্মরিত। ‘কুসুমের মাস’ কবিতায় বসন্তের এত আয়োজন কবির কাছে ‘সব শূন্য মনে হয়’: এ বিফল জন্ম মোর ত্বরা করি হোক অবসান। বসন্ত কাঁদিয়া ফেরে বন হতে বনে বনান্তরে সকল সম্ভার তার শেষ হলো অ-কালের ঝড়ে! কিন্তু কবি প্রকৃতির রূপকে শুধু যে বেদনা রিক্ত করেছেন তা নয়; বসন্তের রঙে-রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি এর স্তুতিও করেছেন। ‘কুসুমের মাস’ কবিতায় আমের মুকুল ও বাতাবি ফুলের সঙ্গে মাধবী ও শিমুলেরা বাসন্তী বাগানে আনন্দঘন হয়ে উঠেছে। সেই সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কোকিলের সুকণ্ঠ। কবি বেদনা ভুলে আনন্দে মেতে ওঠেন। আজি এতদিনে কোকিল কণ্ঠে নিশীথ রাত্রে বারতা এল এল বসন্ত! জাগিছে ধরণী কবি! তুমি আজ নয়ন মেল। ‘হে সাগর’ কবিতায় কবি সাগরের দুরন্ত উন্মত্ততাকে ভালবেসে অবোধ শিশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিশু মনের সঙ্গে যেমন জোর করা যায় না, ভালবাসার আদরে তাকে বশ করতে হয়; কবিও তেমনি মাতৃস্বরূপার চেতনায় সাগরকে ভাল বেসেছেন। সাগর বা নদী তার আপন গতিতে বহমান। তাকে কেউ রোধ করতে পারে না। সুদীর্ঘ সাগরের চলার গতিকে কবির কাছে শক্তিমান কিশোরের রুদ্ধ অভিমান বলে মনে হয়েছে। সে শুধু ধ্বংস করে না; তার সৃষ্টির প্রেরণাও ব্যাপক। সে ‘ক্ষমতার মধুর রসে’ ফুলে-ফসলে ভরে তোলে জীবন। প্রকৃতির সঙ্গে মিতালী বেঁধে কবি প্রকৃতি-প্রেমের প্রশংসা করেছেন ‘আকাশ মৃত্তিকা’ কবিতায়। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে আকাশের সঙ্গে মাটির নিবিড় মমতা বিরাজমান। দুজন-দুজনাতে মিলে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে বিভোর হয়। আকাশ তার নীল নয়ন মেলে বেদনার জল বর্ষণ করে মাটির বুকে। মাটি তার রসে ফল-ফসলে ও পুষ্পের গন্ধে মুখরিত হয়। শ্যামল পল্লবে জাগে ‘কাজল আঁখির’ সুশীতল জলের ছায়া। আকাশ মাটির এই মায়ায় মুগ্ধ হয়ে বিশ্ববিধাতা তার সৃষ্টিতে পরিতৃপ্তি লাভ করেন ‘রূপসী বাংলা’ কবিতায় তারই ইঙ্গিত : এখানে মাটিতে মায়া, আকাশ মিতালী মন দিয়া মাটিরে চুমিয়া যায় দিগন্তের সীমানা বাহিয়া। বাংলার সবুজ প্রান্তর, তার বন-কান্তারে প্রস্ফুটিত ফুল সমাহারে, কুঞ্জে কুঞ্জে দোয়েল, গানের শ্রবণ, ‘সমুদ্র-মেখলা নদী-পরিবৃতা পলল প্রকৃতি, দিগন্ত বিস্তৃত সুনীল আকাশ, ষড়ঋতুর বিচিত্র সমারোহ, সকালের নব নব আকাশ, সন্ধ্যাকাশ, কবির প্রাণে সহজ স্বাক্ষররূপে প্রতিভাত হয়েছে।’ সুফিয়া কামালের কবিতায় শুধু প্রকৃতির রূপ-মাধুর্যের বর্ণনা নেই; আছে প্রকৃতির বহুল ব্যবহার। জীবনের প্রতিধাপে সময়-পরিবেশ অনুযায়ী প্রকৃতিতে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে প্রকৃতি থেকে জীবনকে আলাদা করা যায় না। জীবন ও প্রকৃতি হয়েছে একে অপরের পরিপূরক। তাই উদার প্রকৃতির রূপের বাহুতে বেষ্টিত সুফিয়া কামালের কবিতার পঙ্ক্তিমালা। যেখানে কবি প্রকৃতির মূর্তিকে উদ্ভাসিত করেছেন হৃদয়ের মমতায়। আর তাকে বাণীবদ্ধ করেছেন শ্যামল বাংলার শ্বাশত রূপে। যেখানে কবি প্রকৃতির মূর্তিকে উদ্ভাসিত করেছেন হৃদয়ের মমতায়। আর তাকে লিপিবদ্ধ করেছেন শ্যামল বাংলার চিরায়তরূপে। কবির প্রকৃতির সঙ্গে এই অঙ্গাঙ্গীভাবে এক হয়ে যাওয়া- প্রকৃতিকে প্রাণরূপ দান করে প্রকৃতির সঙ্গে লাভে, ক্ষতিতে, আনন্দ, বেদনায়, হারানো, প্রাপ্তিতে আপনজন হয়ে ওঠার থেকে আমাদের এই প্রকৃতি বিরুদ্ধ নগর সভ্যতা আর প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন জীবন অভ্যস্ততায় শেখার মতো অনেক প্রয়োজনীয় বার্তা আছে। প্রকৃতির প্রতি কবির সুখ সান্নিধ্য বা দুঃখবোধ ভাগাভাগি বর্তমানে লুপ্তপ্রায় প্রকৃতির প্রতি আমাদের নিঃস্ব মায়াকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে। কৃত্রিম জীবনে অভ্যস্ত অনুরাগহীন কঠোর প্রাণ মানুষকে প্রকৃতির প্রতি বন্ধুসুলভ হতে চালিত করতে পারে। সুফিয়া কামাল তার প্রকৃতি অনুরক্ততার আড়ালে বলে যেতে চেয়েছেন মানুষ আর প্রকৃতি একে অপরের পরিপূরক। তাই প্রকৃতি ভক্ষক আধুনিক জীবনধারা পাল্টে আমাদের সময় এসেছে প্রকৃতি রক্ষক হওয়ার। একাকী সুফিয়া কামাল প্রকৃতির নির্জনতায়, ছায়ায়, মায়ায়, কোমলতায়, বদান্যতায়, পেয়েছিলেন এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সাহচার্য- যার সঙ্গে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেয়া যায়। মানুষ যত বেড়েছে মানুষে মানুষে দূরত্বটাও বেড়েছে তত- তাই প্রকৃতিকে তার আদিম ও কুমারীরূপে রেখে আমরাও আমাদের অপূর্ণতাকে, জীর্ণতাকে, শূন্যতাকে পূর্ণ করতে পারি কারণ প্রকৃতি উদার, অকৃত্রিম ও সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। যেমনভাবে সুফিয়া কামাল ‘আমার নিশীথ’ কবিতায় প্রকৃতির আশ্রয়ে নির্ভার হন- ‘তোমার আকাশ দাও মোর মুক্ত বিচরণ ভূমি শিখাও আমারে গান। গাহিব, শুনিবে শুধু তুমি। মুক্ত-পক্ষ এ বিহগী তোমার বক্ষেতে বাঁধি নীড় যাপিবে সকল ক্ষণ স্থির হয়ে, চঞ্চল অধীর। আঁধার গুণ্ঠন টানি কানে কানে কব সেই কথা যে-কথা গুমরে বক্ষে প্রকাশের কত ব্যাকুলতা।’
×