ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রামের অধিকাংশ হাটবাজার রাস্তাঘাট এখনও পানির নিচে

সিলেটে বন্যার পানি নামছে ধীরে, নানা সঙ্কট

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৫ মে ২০২২

সিলেটে বন্যার পানি নামছে ধীরে, নানা সঙ্কট

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ ধীরগতিতে নামছে বন্যার পানি। সুরমা, কুশিয়ারা, ধলাই, পিয়াইন বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গ্রামের অধিকাংশ হাটবাজার, রাস্তাঘাট এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। গ্রামের হাটবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসেরও সঙ্কট রয়েছে। অনেক স্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থার অজুহাত দেখিয়ে ছোট দোকানিরা অধিক মূল্যে জিনিস বিক্রি করছেন। গ্রামের বন্যাকবলিত এলাকায় খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় পানি কমলেও বন্যার্তদের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে। পানি কমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বানভাসি এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে পড়েছেন। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত লোকজনের মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ শহরের বন্যাকবলিত এলাকায় মেডিক্যাল টিম গঠন করেছে সিলেট সিভিল সার্জন ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া বন্যাকবলিতদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ করছেন তারা। সিলেট জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ এস এম শাহরিয়ার বলেন, ‘বন্যার কারণে পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। ৩৭৬ জন লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি ৬ জন চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের মেডিক্যাল টিম ইউনিয়ন পর্যায় থেকে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে। যাতে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে না পড়ে। তবে বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিলেটে বন্যাকবলিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৪০টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। যার মধ্যে সিলেট সদরে ১০টি, দক্ষিণ সুরমায় ৮টি, বিশ্বনাথে ১১টি, ওসমানীনগরে ৯টি, বালাগঞ্জে ৭টি, ফেঞ্চুগঞ্জে ১০টি, গোলাপগঞ্জে ১৬টি, বিয়ানীবাজারে ১৬টি, জকিগঞ্জে ১০টি, কানাইঘাটে ১২টি, গোয়াইনঘাটে ১০টি, জৈন্তাপুরে ১১টি এবং কোম্পানীগঞ্জে ৭টি মেডিক্যাল টিম গঠিত হয়েছে। এর বাইরে জেলা সদরে ৩টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। এসব দলে চিকিৎসক ছাড়াও নার্সসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই আছেন। প্লাবিত এলাকার সবখানেই যেন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রতিটি মেডিক্যাল টিমকে নির্দেশনা দেয়া আছে। এরপরও পুরো বিষয়টি যেন সুষ্ঠুভাবে করা যায়, এ জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয় তদারকি করছে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ আবুল কালাম আজাদ, বলেন এখনও সেভাবে রোগ-ব্যাধি ছড়ায়নি। কেবল বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধির শঙ্কা রয়ে যায়। তবে সেজন্য আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে, সব রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আমরা তৎপর রয়েছি। কেউই চিকিৎসার বাইরে থাকবেন না। ‘সিলেটে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের জন্য নগরের শাহী ঈদগাহ এলাকায় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে, একইসঙ্গে নগরের রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে’ বলেও জানান এ চিকিৎসক। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে তিনটি মেডিক্যাল টিম মাঠে আছে, প্রয়োজনে আরও গঠন করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া কিংবা অন্যান্য রোগের প্রকোপ দেখা যায়নি। এর কারণ বিশুদ্ধ পানি ও পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। তবে পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর সে রোগগুলোর ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা আছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মেডিক্যাল টিম নিয়মিত পরিদর্শন করছে’ বলেও তিনি জানান। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। পানি দ্রুত নেমে যেতে শুরু করেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দ্রুতই পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।’ বন্যায় ক্ষতি সারাতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে ॥ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেটের সড়ক অবকাঠামো। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার সড়ক বন্যার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত। এসব ক্ষতি সারাতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। দায়িত্বশীলরা জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের মধ্যে সড়ক ও জনপথের (সওজ) অধীন প্রায় ৭২ কিলোমিটার, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) ২৬৭ কিলোমিটার এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৪০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এবারের বন্যায় সিলেটে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সড়ক তলিয়ে যায়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার সড়ক। এর বাইরে সদর উপজেলা ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় দুটি কালভার্ট ভেঙ্গে গেছে। সওজ কার্যালয় সূত্র জানায়, সারি-গোয়াইনঘাট সড়কের ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়কের ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার, কানাইঘাটের দরবস্থ-কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের ১৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় তলিয়ে যায়। এছাড়া বিশ্বনাথ-লামাকাজি সড়ক, কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়ক, শেওলা-সুতারকান্দি সড়ক এবং বিমানবন্দর-বাদাঘাট-কুমারগাঁও সড়কের বিভিন্ন অংশ ছিল পানির নিচে। সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, বন্যায় সওজের অধীন ১০টি সড়কের প্রায় ৭২ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক সংস্কারে প্রায় ৬০-৭০ কোটি টাকা লাগবে। বন্যার্তদের সাহায্যে শাবির শিক্ষার্থীরা ॥ সিলেট অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সুনামগঞ্জে বন্যায় শত কোটি টাকার ক্ষতি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ জানান, সুনামগঞ্জে অকাল বন্যায় কৃষি ও যোগাযোগ খাতে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ক্ষতির তালিকায় আছে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা; তলিয়ে গেছে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল; ভেসে গেছে হাজারের বেশি পুকুরের মাছ। ভারতে অতিবৃষ্টির ফলে গত ১৭ এপ্রিলের পর জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় পানি বাড়তে থাকে। সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, পুরাতন সুরমাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে। পানির চাপে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যায় কোথাও কোথাও। কুড়িগ্রামে পানির নিচে ২শ’ ৬৫ হেক্টর জমির বোরো ধান ॥ স্টাফ রিপার্টার, কুড়িগ্রাম জানান, এক সপ্তাহ ধরে অবিরাম বর্র্ষণে কুড়িগ্রামে প্রধান নদনদীর পানি বেড়ে গেছে। ফলে এসব নদীর তীরের নিম্নঞ্চলসমূহের কিছু কিছু জায়গায় তলিয়ে গেছে সদ্য উঠতি বোরো ধান। কৃষকরা দ্রুত সেসব ধান কেটে নিচ্ছেন। অনেকেই কাঁচা ধান বাধ্য হয়ে কেটে গরুকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়ন ও মোগলবাসা এলাকার ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার কিছু চরাঞ্চলে ধান খেত তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। কয়েকদিনের টানা বর্ষণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। ফলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। গোমস্তাপুরে সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমির ধান পানির নিচে ॥ জাহিদ হাসান মাহমুদ মিম্পা, চাঁপাাইনবাবগঞ্জ থেকে জানান, ভারত থেকে নেমে আসা উজানের অতিরিক্ত পানিতে ১৬ মে রাত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমির ধান। অসময়ের বন্যায় সব কিছু হারিয়ে দিশেহারা উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিল কুজাইন, ভাটখোর, রোকনপুরগঞ্জ, যশৌল, বিভীষণ, সিংগাবাদ মৌজার কৃষকরা।
×