ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াটার ট্যাক্সি বন্ধ ও সকল বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ

হাতিরঝিলের পানির ক্ষতি করা যাবে না ॥ হাইকোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২৫ মে ২০২২

হাতিরঝিলের পানির ক্ষতি করা যাবে না ॥ হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি ও এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনভাবেই ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া বর্তমানে পরিচালিত ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস চলাচল বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে হাতিরঝিল এলাকার সব বাণিজ্যিক স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাতিরঝিলের ব্যবসায়িক স্থাপনা উচ্ছেদে জারি করা রুলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি রায়ে চার দফা নির্দেশনাসহ ৯টি পরামর্শ দিয়েছেন আদালত। গত বছরের ৩০ জুন বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিল সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেন। মঙ্গলবার ৫৫ পৃষ্ঠায় দেয়া এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে, যা সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি এবং এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনরূপ ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না। প্রতিটি ফোটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোন সম্পদ এ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং প্রতিটি ফোটা পানির দূষণ প্রতিরোধ করা একান্ত আবশ্যক। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রজেক্টে লে আউট প্ল্যানের নির্দেশনার বাইরে কতিপয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধে রাজউকের নিষ্ক্রিয় থাকার প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ২০১৮ সালে রিট করেন পরিবেশবাদী ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে ওই রুলের শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৩০ জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী রিপন বাড়ৈ, সঞ্জয় ম-ল। রাজউকের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী ও আশেক মোমিন। রায়ে বলা হয়, ‘প্রতি ফোটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোন সম্পদ এ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং প্রতিটি ফোটা পানির দূষণ প্রতিরোধ একান্ত আবশ্যক।’ পানির অস্তিত্ব নিয়ে হাইকোর্ট বলেন, দেয়ার ইজ নো ‘প্ল্যানেট বি।’ দ্বিতীয় কোন পৃথিবী নেই। এ পৃথিবী ব্যতীত আর কোন গ্রহে পানির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে এক ফোটা পানি এ পৃথিবীর বাইরে থেকে আনতে সক্ষম হয়নি। অথচ এ খরচের শতভাগের একভাগ টাকা খরচ করলে আমরা আমাদের গ্রহের পানিকে দূষণমুক্ত ব্যবহারযোগ্য রাখতে সক্ষম। হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নিয়ে আদালত বলেন, হাতিরঝিলের পানি ও এর নজরকাড়া সৌন্দর্য অমূল্য সম্পদ। এ অমূল্য সম্পদকে কোনভাবে ধ্বংস বা ক্ষতি করা যাবে না। রায়ে হাইকোর্টের চারটি নির্দেশনা হলো- ১. সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদী রায় মোতাবেক রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বেগুনবাড়ি খালসহ হাতিরঝিল এলাকা যা ‘হাতিরঝিল’ নামে পরিচিত পাবলিক ট্রাস্ট প্রপার্টি তথা জনগণের জাতীয় সম্পত্তি। ২. ‘হাতিরঝিল’ এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সবল প্রকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ এবং নির্মাণ সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন এবং তুরাগ নদীর রায় অনুযায়ী বেআইনী ও অবৈধ। ৩. ‘হাতিরঝিল’ প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দকৃত সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে এসব বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো। ৪. এ রায়ের অনুলিপিপ্রাপ্তির পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। এ ছাড়া হারিঝিলের বিষয়ে হাইকোর্ট কিছু পরামর্শ দেন। সেগুলো হলো- হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিচালনায় একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ তথা ‘হাতিরঝিল লেক সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সরাসরি অধীন গঠন করা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ, জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিকমানের টয়লেট স্থাপন করা। নির্ধারিত দূরত্বে বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্য পান করার পানির ব্যবস্থা করা। পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরি করা। পানির জন্য ক্ষতিকর হেতু লেকে সবল প্রকার যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। লেকে মাছের অভয়ারণ্য করা। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার ব্যয় রেভিনিউ বাজেট থেকে বরাদ্দ করার পরামর্শ দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছেন, এ মামলাটি চলমান থাকবে।
×