ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অস্বাভাবিক কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না ॥ বিইআরসি

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে এ মাসেই

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২০ মে ২০২২

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে এ মাসেই

স্বপ্না চক্রবর্তী ॥ বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, দেশে প্রতিবছর বিদ্যুত উৎপাদনে ঘাটতি গুনতে হয় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর তাই দাম বাড়াতে প্রস্তাবনা জমা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। এর প্রেক্ষিতে দাম বাড়াতে গণশুনানি শুরু করেছে কমিশন। এর আগে আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। এই প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে গত মার্চে গণশুনানি শেষ করেছে বিইআরসি। গণশুনানির ভিত্তিতে চলতি মাসেই ঘোষণা আসতে যাচ্ছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির। এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামের উর্ধগতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। এর মধ্যে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়লে জনজীবনে চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বিইআরসি বলছে, অস্বাভাবিক কোন সিদ্ধান্তই নেয়া হবে না, যা জনগণের ওপর চাপ ফেলবে। আর বিদ্যুত, জ্বালানি, এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার কারণে দাম হয়তো বাড়তে পারে। তবে তা জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যেই থাকবে। বুধবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে প্রথম গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। এতে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এর আগে পিডিবি ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়াতে বিইআরসির কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। এই সুপারিশ ও গণশুনানির ভিত্তিতে কমিশন দাম বাড়ানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হয় পিডিবির জন্য। পিডিবি গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই দামে বিদ্যুত সরবরাহ করে। কারিগরি কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, ভোক্তা পর্যায়ে দাম না বাড়ালে পাইকারি মূল্যহার কার্যকর করা সম্ভব হবে না। পিডিবি বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতির পুরোটা সরকারের পকেট থেকে দিতে হয়, যা দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আর তাই দাম বাড়ানো প্রয়োজন। একইভাবে গত মার্চে গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানিতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১২ টাকা ৪৭ পয়সা নির্ধারণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি (মূল্যায়ন) কমিটি। এখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা ৩৬ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা ১১ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে গ্যাসের দাম প্রায় ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এর আগে বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের খুচরা মূল্য ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠায় জানুয়ারি মাসে। তাতে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ ছাড়া আবাসিকে প্রিপেড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারের বিদ্যমান মূল্য ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭.৩৭ টাকা, সিএনজি প্রতি ৩৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৬.০৪ টাকা, হোটেল-রেস্টুরন্টে ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৯.৯৭ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১৭.০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৭.০২ টাকা, ১০.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৩.৮৫ টাকা থেকে ৩০.০৯ টাকা, চা শিল্পে ১০.৭০ টাকা বাড়িয়ে ২৩.২৪ টাকা করার প্রস্তাব করে। অন্যদিকে, বিদ্যুত ও সার কারখানায় থাকা বিদ্যমান দর ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৬৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। বাড়তি বিদ্যমান গড় ৯.৩৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে এতটা বেশি একবারে বাড়বে না বলে আশ্বস্ত করে বিইআরসির চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল জলিল জনকণ্ঠকে বলেন, আপনারা আন্তর্জাতিক বাজার নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করছেন। এই অস্থিরতার প্রভাব দেশে অবশ্যই পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে দাম বাড়বেই। গ্যাসের দাম বাড়ানোর শুনানি শেষ হয়েছে এক মাসের বেশি সময় হয়েছে। আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানাতে হবে আমাদের। এখনও আমাদের হাতে ৩০ থেকে ৪০ দিন সময় আছে। এই সময়ের মধ্যেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে। তবে এটা আমরা বলতে পারি, পেট্রোবাংলা যে প্রস্তাবনা দিয়েছে, তা কিছুটা অস্বাভাবিক। ওই হারে নিশ্চয়ই বাড়বে না। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কি- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি তো মাত্র শুনানি শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। তবে সব কিছুতেই গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনা করা হবে। তবে পিডিবি যে ঘাটতির কথা বলছে, এই ঘাটতি থাকবে না সঠিক পরিকল্পনা ধরে এগুলো বলে মন্তব্য করেছেন কনজুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। বিদ্যুতের গণশুনানিতে তিনি বলেন, অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় হলে বিদ্যুত খাতে ৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। মূল্য বৃদ্ধি কিংবা ভর্তুকি প্রদানের প্রয়োজনই হবে না। তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকারী বিদ্যুতকেন্দ্রের ওপরে ৬ ভাগ নতুনভাবে কর আরোপ করা না হলে, তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা না হলে, কয়লার ওপর ৫ ভাগ ভ্যাট নতুনভাবে আরোপিত না হলে, ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহৃত তেল বিপিসির মাধ্যমে আমদানি হলে মোট ৮ হাজার ৮৩৩ কোটি ঘাটতি কমবে। শুধু তাই নয়, অবৈধভাবে নির্ধারিত ডিজেল ও ফার্নেসওয়েলের বর্ধিত মূল্য এবং কুইক রেন্টালের বিদ্যুত অবৈধভাবে ক্রয়কৃত মূল্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে সমন্বয় না হলে, ঘাটতি কমবে ১৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া, ১৩২ কেভি থেকে তদুর্ধের ভোল্টেজ লেভেলের ভোক্তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার ভর্তুকিযুক্ত হলে এবং বিতরণ ইউটিলিটি ভেদে তা অভিন্ন হলে পিডিবির আয় বাড়বে, অর্থাৎ ঘাটতি কমবে ১৩২৮ কোটি টাকা। তা ছাড়া পিডিবির কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্টগুলোতে ৫৩ ভাগের পরিবর্তে ৬৭ ভাগ পিএফ-এ বিদ্যুত উৎপাদন হলে সাশ্রয় হবে ১৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। একইভাবে দেশের ১৯টি পিবিএস-এ ভোক্তা মিশ্রণ পিডিবি, ডেসকো ও ডিপিডিসির সমতুল্য। তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্যহার যৌক্তিক করা হলে সাশ্রয় হবে ৩৫৫৬ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ভর্তুকি প্রদান না করে এবং খরচ কমানোর যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ক্যাবের প্রস্তাব বিবেচনা করলে দাম বাড়ানো লাগবে না। গ্রামে এখনও লোডশেডিং হচ্ছে। প্রয়োজনে পরিকল্পিতভাবে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে গ্যাস হোক আর বিদ্যুত হোক, দাম বাড়ালে এটি সাধারণ মানুষের ওপর যেন চাপ না সৃষ্টি হয়, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে মন্তব্য করে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়বে কি না, তা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সরকার ভতুর্কি এমন কোন সিদ্ধান্ত নেবে না, যা গ্রাহকের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে না। এদিকে, গ্যাসের পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কথা-বার্তা শুরুর পর থেকেই আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে বেসরকারী কোম্পানিতে কর্মরত মাহফুজুর রহমান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের যে উর্ধগতি তা সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
×