ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভাল মানের তৈরি চা কালোবাজারে বিক্রি করে নিম্নমানের চা নিলামে ওঠানোর অভিযোগ সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

সিন্ডিকেটের কবলে ধ্বংসের মুখে উত্তরের চা শিল্প

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১৫ মে ২০২২

সিন্ডিকেটের কবলে ধ্বংসের মুখে উত্তরের চা শিল্প

এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড় ॥ দেশের তৃতীয় চা বাগান এলাকা পঞ্চগড় তথা উত্তরাঞ্চলে চা চাষ করে বিপাকে পড়েছেন চাষীরা। কাঁচা চা পাতা আহরণের ভর মৌসুমে চা প্রক্রিয়াজাত কারখানার মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাঁচা চা পাতার দর কমিয়ে দেয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চা চাষীরা। মৌসুমের শুরুতে হঠাৎ কাঁচা চা পাতার দাম অর্ধেকে নেমে আসায় বিক্ষুব্ধ চা চাষীরা প্রতিবাদ সভা-সমাবেশসহ জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। চাষীদের অভিযোগ, অধিক মুনাফার আশায় মালিকরা চা প্রক্রিয়াজাত কারখানায় উৎপাদিত ভাল মানের তৈরি চা (মেড টি) সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন আর নিম্নমানের তৈরি চা (মেড টি) অকশন মার্কেটে নিয়ে নিলামে তুলছেন। সব সেক্টরকে ম্যানেজ করেই মালিকরা এসব করছেন। এতে করে অল্প কিছুদিনের মধ্যে কারখানা মালিকরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। অথচ এসব দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। চাষীরা অভিযোগ করেন, গত বছর একই সময়ে চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ২২ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে কিনলেও এবার সেই একই বাগানের তোলা কাঁচা চা পাতা বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকা থেকে ১৪ টাকা ৫০ পয়সায়। একেতো চায়ের দাম কম তার ওপর প্রতি কেজি চা পাতা থেকে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ কেটে নেয়া হচ্ছে। এতে চাষীরা প্রতি কেজি চা বিক্রি করে দাম পাচ্ছেন মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকা। এই দরে চা বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তো উঠছেই না, উল্টো বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষীদের। এতে মাথায় হাত পড়েছে তাদের। এ যেন পঞ্চগড় তথা উত্তরের ৫ জেলায় চা শিল্পে অশনিসংকেত। স্থানীয় চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলো বিভিন্ন কৌশলে সিন্ডিকেট করে নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতে এমন অপকৌশল গ্রহণ করছে বলে অভিযোগে জানা গেছে। অজুহাত হিসেবে কারখানা মালিকরা বলছেন, এবার উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার মান ভাল নয়, পাতার বয়স বেশি, চার পাতার বেশি পাতা কাটা হচ্ছে। ফলে অকশন মার্কেটের নিলামে তারা ভাল দাম পাচ্ছেন না। অকশন মার্কেটে নিলামে তৈরি চায়ের (মেড টি) উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় কাঁচা চা পাতার দাম কমানো হয়েছে বলে তারা জানান। তবে, চাষীরা বলছেন, অকশন মার্কেটে নিম্নমানের চা নিলামে তোলায় দাম পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম। সিলেট, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের তৈরি চায়ের (মেড টি) প্রতিকেজির দাম যেখানে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে সেখানে উত্তরাঞ্চলের তৈরি চায়ের (মেড টি) দাম পাওয়া যাচ্ছে প্রতিকেজি মাত্র ১৪০ টাকা। চা বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্চগড় তথা উত্তরাঞ্চলের উৎপাদিত চায়ের মান খুবই উন্নত, যা দার্জিলিং ভ্যারাইটির মতো। অথচ নিম্নমানের তৈরি চা অকশন মার্কেটে তুলে নিলাম মূল্য অনুযায়ী প্রতিবছর কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে, এ অঞ্চলের চাষীরা লাভের পরিবর্তে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এক সময়ের মঙ্গা কবলিত উত্তর জনপদে চা আবাদের ফলে সেই মঙ্গাও উধাও হয়ে গেছে। এখন কেউ অভাব অনটনের মধ্যে নেই। উত্তর জনপদের মানুষ এখন স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। বাড়ির আঙ্গিনাসহ ফেলে রাখা পতিত জমিতেও চা চাষ হচ্ছে। এই সমতল ভূমিতে চা চাষে নিরুৎসাহিত করতে মহল বিশেষের কারসাজি বলে চাষীদের অভিযোগ। চাষীরা তাদের উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল না পেলে এ অঞ্চলে চায়ের পরিবর্তে বিকল্প চাষে ঝুঁকবে। আর এতে করে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে সমতল ভূমির চা শিল্প। অভিযোগে আরও জানা যায়, গত দুবছর ধরে চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা মালিকরা চাষীদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছেন। প্রতিটি কারখানা মালিক একটা ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেট চা চাষীদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। চায়ের এই ভরা মৌসুমে চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোতে দুপুর ১টার পর চাষীদের কাছ থেকে আর পাতা কিনছে না। মালিকপক্ষের কিছু দালালের মাধ্যমে কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাঁচা চা পাতা পানির মূল্যে কিনে নিচ্ছেন। চাষীদের অভিযোগ, সরকারী অফিস-আদালত ও হাট-বাজারসহ সব জায়গায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হলেও চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাগুলোতে দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধে কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। চাষীরা জানান, তাদের প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদন করতে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। আর সেই চা পাতা কারখানায় নিয়ে বিক্রি করে পাচ্ছেন ৮ থেকে ১০ টাকা। দিনের পর দিন কারখানা মালিকদের এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে লোকসান গুনছেন সমতলের ৬ থেকে ৭ হাজার চা চাষী। ঋণ করে যারা চায়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের মাথায় হাত পড়েছে। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটের কবল থেকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করার পাশাপাশি কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ অবিলম্বে পঞ্চগড়ে নিলাম বাজারের কার্যক্রম চালুরও দাবি জানিয়েছেন চা চাষীরা। এছাড়াও কালোবাজারে ভালমানের তৈরি চা পাচার বন্ধে প্রতিটি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানার সামনে চা চাষীদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোরও দাবি জানানো হয়েছে। তেঁতুলিয়ার ক্ষুদ্র চা চাষী আবু হানিফ বলেন, চায়ের বাগান পরিচর্যা, সার ও বালাই নাশক ওষুধ, পাতা উত্তোলন ও পরিবহন খাতে যে ব্যয় হয় সেখানে কাঁচা চা পাতা বিক্রি করে ওই ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকা তোলাই দায় এমন দরপতনে। চা বাগান মালিক ও কেন্দ্রীয় কৃষকলীগ নেতা আব্দুল লতিফ তারিন ক্ষোভের সঙ্গে জানান, বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে কারখানা মালিকরা শক্ত সিন্ডিকেট করে দিনের পর দিন চা চাষীদের শোষণ করে যাচ্ছে। তারা নিলাম মার্কেটে নিম্নমানের তৈরি চা বিক্রি করছেন। যাতে করে ওই নিম্নমানের চায়ের গড় দরে অল্প টাকায় কাঁচা পাতার দাম নির্ধারণ করা হয়। ভালমানের চা তারা অবৈধভাবে খোলা বাজারে গোপনে বিক্রি করছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। পঞ্চগড় সদর উপজেলার মীরগড় এলাকার নারী চা চাষী আফরোজা বানু জনকণ্ঠকে বলেন, সাড়ে তিন বিঘা জমিতে চা চাষ করে ঈদের আগে প্রথম রাউন্ডে ২ হাজার ২শ’ কেজি চা পাতা আহরণ করে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৪৮ হাজার টাকা পেয়েছেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে ১৯৩০ কেজি চা ২৫ শতাংশ কর্তন করে কারখানা মালিক ১ হাজার ৪শ’ ৪৭ কেজি চায়ের দাম দিয়েছেন ২০ হাজার ২২৪ টাকা। ৪০ দিনের ব্যবধানে তার লোকসান অর্ধেকের বেশি। তিনি আরও বলেন, বাগান পরিচর্যা, বালাইনাশক, সার ও শ্রমিকের মুজুরি পরিশোধ করে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতায় আর্থিক লোকসান হয়েছে ৩ টাকা। আটোয়ারীর চা বাগান মালিক মতিয়ার রহমান জানান, এক সময় জেলায় আখ চাষ হতো। চাষীরা আখ চাষ করে বেশ লাভবানও হয়েছিল। আখ চাষের জন্য পঞ্চগড়ে ভারি শিল্প হিসাবে পঞ্চগড় সুগার মিল স্থাপন করা হয়। কিন্তু সুগার মিলের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার অতি মুনাফা লাভের অপকৌশল, আখ বিক্রি করে সঠিক সময়ে চাষীদের টাকা না পাওয়া আর সর্বোপরী আখের দর পতনের কারণে চাষীরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। যার ফলে জেলার একমাত্র ভারি শিল্প সুগার মিলটি এখন বন্ধ। একই অবস্থা হবে চা কারখানাগুলোর এমন অনৈতিক কৌশলের কারণে। তবে চায়ের হঠাৎই এমন দরপতন বিষয়ে গ্রীন কেয়ার চা কারখানার ম্যানেজার মনজুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, পঞ্চগড়ে উৎপাদিত নিম্নমানের চা চট্টগ্রাম অকশন মার্কেটে নিলাম না হওয়ায় এবং চা পাতার মান ভাল না হওয়ার কারণে কাঁচা চা পাতার দর কিছুটা কমেছে। একথা অস্বীকার করে চাষীরা বলছেন, নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতেই কারখানা মালিকরা এমন অনৈতিক গল্পের নাটক মঞ্চায়ন করছেন। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকেও কারখানা মালিকসহ একটি বিশেষ কুচক্রী মহল বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চায়ের অকশন মার্কেটটি পঞ্চগড় থেকে অন্যত্র স্থাপনের চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছেন। চা চাষীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পঞ্চগড়েই করা হোক চায়ের অকশন মার্কেট। এর ব্যত্যয় হলে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচী দেয়া হবে বলে চাষীরা বলেছেন। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে গঠিত কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রতি মৌসুমে চা পাতা বিক্রির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে, গত মৌসুমের শেষ দিকে তৈরি চায়ের নিলাম বাজার অনুযায়ী নির্ধারণ করা প্রতিকেজি চা ১৫ টাকা ৫০ পয়সা এখনও থাকলেও কারখানা মালিকরা সেটিও মানছেন না। চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে চাষীদের কাঁচা চা পাতার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি চা বোর্ডের নজরে এসেছে। এছাড়াও চাষীরা জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিতভাবে দাম বৃদ্ধির অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে আগামী ১৮ মে জেলা প্রশাসক অফিসের সম্মেলন কক্ষে সকল পক্ষকে নিয়ে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। আশা করি ওই সভায় বিষয়টির সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একটি প্রশ্নেই দেশের উত্তর জনপদের জেলা পঞ্চগড়ের বিস্তীর্ণ গোচারণ ও একফসলি জমি এখন চায়ের সবুজ পাতার বিপ্লব ঘটিয়েছে। গত দুই দশক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে সীমান্তের ওপারে ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে চা বাগান থাকলে এখানে হবে না কেন এই একটি প্রশ্নেই পাল্টে যায় পঞ্চগড়ের চিত্র। চা আবাদে বদলে দেয় এ জেলা তথা উত্তরের পাঁচ জেলার দৃশ্যপট। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের নতুন পথ। কয়েক হাজার শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকার মানুষ কাজের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পান। শুধু তাই নয়, ঘরে বসে থাকা কর্মহীন নারীরা বাড়ির পাশের চা বাগানে চা পাতা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করে সচ্ছলতার পথ খুঁজে পেয়েছেন। অন্যান্য ফসলের চেয়ে চা চাষ লাভজনক হওয়ায় দ্রুতই চা চাষের পরিধি যেমন বেড়েছে তেমনি নতুন নতুন চা প্রক্রিয়াজাত কারখানাও গড়ে উঠেছে। পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের তথ্য মতে, পঞ্চগড় জেলা ও পার্শ্ববর্তী জেলার উৎপাদিত চা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ২২টি কারখানা তাদের উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আরও ২০টি কারখানা স্থাপনের অনুমতি নেয়া আছে। বর্তমানে জেলায় ১১ হাজার ৪শ’ ৩৪ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। গত মৌসুমে ২২টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা কাঁচা চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি তৈরি চা (মেড টি) উৎপাদন করে। চলতি বছর তা বেড়ে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্যের দাবিতে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ায় চা চাষীরা মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
×