ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নাসিক নির্বাচন ॥ রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তা

ঐক্য সুদৃঢ় আওয়ামী লীগের বিএনপি হতাশ

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২১ জানুয়ারি ২০২২

ঐক্য সুদৃঢ় আওয়ামী লীগের বিএনপি হতাশ

শরীফুল ইসলাম ॥ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। নজিরবিহীন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিলে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এদিকে নাসিক নির্বাচনে কার লাভ ও কার ক্ষতি হয়েছে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে বড় দুই রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন নিয়ে হিসাব কষছে। ঐতিহাসিক সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নাসিক নির্বাচন হওয়ার বিষয়টি এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও এ নিয়ে কথা হচ্ছে। এতে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এর ফলে আগে যারা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করত তারাও এখন ইতিবাচক মন্তব্য করছেন। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, নাসিক নির্বাচনে একজন ভাল মেয়র প্রার্থী দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ। ভাল প্রার্থী থাকায় ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টিতে কাউন্সিলর পদেও বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় বিএনপি ১০টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হয়েছে। বাকি ৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১টিতে জাতীয় পার্টি, একটিতে বাসদ ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। আর সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৪টিতে আওয়ামী লীগ, ২টিতে বিএনপি, ২টিতে জাতীয় পার্টি, ১টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। দলের চরম বৈরী পরিস্থিতিতে মেয়র পদে পরোক্ষভাবে সমর্থন করা বিএনপির প্রার্থী ৯২ হাজারের বেশি ভোট পাওয়া এবং ১০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ও ২টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হওয়ায় বিএনপিও লাভবান হয়েছে। তবে সরাসরি দল থেকে প্রার্থী করে প্রকাশ্যে মাঠে থাকলে এ নির্বাচন আরও বেশি আকর্ষণীয় হতো এবং বিএনপিও বেশি লাভবান হতো। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ডের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এ সুযোগটি নিতে পারেনি বিএনপি। এদিকে নাসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা বিভেদ পরিলক্ষিত হলেও শেষ দিকে তা দূর হওয়ায় এবং দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় এ দলটির ঐক্য সুদৃঢ় হয়েছে। দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীসহ দেশের মানুষ এটিকে খুব ভালভাবে গ্রহণ করেছে। দলের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে এ চিত্রও দেশবাসীর কাছে ফুটে উঠেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পড়বে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। অপরদিকে বিএনপি তৈমুর আলম খন্দকারকে নীরবে মেয়র পদে সমর্থন দিয়ে তলে তলে তার পক্ষে নির্বাচন করেছে। যার প্রমাণ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরও তৈমুর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার না করে শুধু দলীয় পদ স্থগিত করে। কিন্তু পরে নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় তাঁকে দলের সকল পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করে। এর মাধ্যমে বিএনপির দ্বিমুখী আচরণ পরিষ্কার হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে বেশ ক’জন বিএনপি নেতা বিজয়ী হলেও তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। কিন্তু নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হওয়ায় তৈমুর আলমকে বহিষ্কার করা হয়। অথচ এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৈমুর আলম খন্দকার দলের ইমেজ বৃদ্ধি করেছেন এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে পেরেছেন। এছাড়া নির্বাচনে পরাজয়ের পরও বিএনপির পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে মেয়র পদে নির্বাচন করা তৈমুর আলম খন্দকার কোন নেতিবাচক মন্তব্য না করায় এবং বিজয়ী নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী তার বাসায় আসার পর তার সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করা এবং ফলাফল মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা করেন। এর মাধ্যমে বিএনপি সম্পর্কে জনমনে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। কিন্তু এরপর বিএনপি হাইকমান্ড তাকে বহিষ্কার করে হীনম্মন্যতার পরিচয় দেয়, যা দেশের মানুষ নেতিবাচক হিসেবে নেয়। এ কারণে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকে নাসিক নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হওয়ায় দেশ-বিদেশে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে ইতিবাচক বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। এর ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে যে অপপ্রচার ছিল তা কিছুটা ম্লান হয়। আর দলীয় সরকারের অধীনেও যে ভাল নির্বাচন হতে পারে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয় সরকার। এছাড়া নাসিক নির্বাচনে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর ভোট হওয়ায় পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররাও ভোট কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহ পাবে। আর ইভিএমে ভোটের প্রতি মানুষের মধ্যে যে ভীতি ছিল সেটাও নাসিক নির্বাচনের পর কেটে গেছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে নাসিক নির্বাচন দেশে গণতন্ত্র চর্চার মডেল হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। তাই এ নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত করলে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও মজবুত হবে। আর তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে বিদেশী কূটনীতিকরা আর নাক গলানোর সুযোগ পাবে না। বরং বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য কোন দেশে সে শিক্ষা তারা প্রয়োগ করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও নজিরবিহীন এ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কোন মন্তব্য করতে না পারার বিষয়টিকে বিদেশি কূটনীতিকরা ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তবে ইলেক্ট্রনিক মেশিনে (ইভিএম) ভোটের গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউ কেউ মৃদু সমালোচনা করেছেন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুরু করে নাসিক নির্বাচনে ভোটের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি ছিল উৎসবমুখর। সকল মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বিঘেœ নির্বাচনী প্রচারের পর তাদের কর্মী-সমর্থকরা নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে অবাধে ভোট দিতে পেরেছেন। একেবারে ব্যতিক্রম এ নির্বাচনে কোন সংঘাত-সহিংসতা বা কোন অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি। সকল প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরাই বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এমনকি নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও কেউ কোন বিরূপ মন্তব্য করেনি। বরং সকল প্রার্থী নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছেন। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ভোট হয়। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নারী ও নতুন ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে কারো কারো আঙ্গুলের ছাপ বারবার চেষ্টার পরও না মেলার কারণে তারা ইভিএমের কারণে ভোট দিতে পারেননি। এছাড়া কেউ কেউ সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ায় ভোটকেন্দ্রে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তবে এমন ভোটারের সংখ্যা খুবই কম। তারপরও ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশ। নাসিক নির্বাচনের আগে কোন কোন মহল থেকে সহিংসতার আশঙ্কা করায় এ নির্বাচন নিয়ে শেষ দিকে প্রার্থী-সমর্থকদের মধ্যে ছিল টান টান উত্তেজনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা কোনরকম সংঘাত-সহিংসতা ছাড়াই নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রেও কোন ধরনের হাঙ্গামা হয়নি। ছিল না পেশিশক্তির দাপট। এমনকি কারো সঙ্গে কারো কথাকাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি। এছাড়া একটি জাল ভোটেরও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নির্বাচনকালে পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও বিজিবির সদস্যরা ছিল কড়া পাহারায়। ম্যাজিস্ট্রেটরাও সার্বক্ষণিক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। এর ফলে ভোটাররা খুশি মনে নির্বিঘেœ যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ভোটের আগেই বলেছিলেন নাসিক নির্বাচন একটি মডেল নির্বাচন হিসেবে উদাহরণ হয়ে থাকবে। আর যেই নির্বাচন কমিশনার সবসময় বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে সবসময় নির্বাচনের অনিয়ম সম্পর্কে সোচ্চার থাকেন সেই নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ভোটের দিন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, নাসিক নির্বাচন আমাদের কমিশনের সর্বোত্তম নির্বাচন। সুষ্ঠু ভোট হওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়া সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যত নির্বাচন হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তবে এবারের নাসিক নির্বাচনের পর তিনিও প্রকাশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় প্রশংসা করেছেন। নাসিক নির্বাচনের পর সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ায় বিদেশী কূটনীতিক এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, ভোট উৎসবের জন্য এমন পরিবেশই কাম্য। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম নাসিক নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এ নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন।
×