ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘাতক স্বামীর স্বীকারোক্তি, বন্ধুসহ ৩ দিনের রিমান্ডে

দাম্পত্য কলহেই চিত্রনায়িকা শিমু খুন

প্রকাশিত: ২৩:২০, ১৯ জানুয়ারি ২০২২

দাম্পত্য কলহেই চিত্রনায়িকা শিমু খুন

আজাদ সুলায়মান/সালাহউদ্দিন মিয়া ॥ দাম্পত্য কলহ, নেশার উন্মাদনা ও পারিবারিবক বিষয়ে মতদ্বৈততার দরুন প্রাণ দিতে হয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুকে (৪০)। সোমবার কেরানীগঞ্জ থেকে বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধারের পর র‌্যাব শিমুর ঘাতক স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল ও তার বন্ধু আব্দুল্লাহ ফরহাদকে আটকের পর পুলিশে সোপর্দ করে। তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল এ হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছেন। একটি প্লাস্টিকের বস্তার সূত্র ধরে পুলিশ হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করে। এ মামলায় তাদের উভয়কে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার একটি আদালত। পুলিশ আবার সেই কাহিনী সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানায়। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের নেপথ্য কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে দাম্পত্য কলহকেই সন্দেহের শীর্ষে রাখা হলেও শিমুর ব্যক্তিগত বা পেশাগত কোন বিরোধ কারও সঙ্গে ছিল কিনা- যা হত্যাকা-ের কারণ হতে পারে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিমুর স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল ও তার বন্ধু ফরহাদকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায়। নিহতের ভাই হারুনুর রশীদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মঙ্গলবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন ওই থানার উপ-পরিদর্শক চুন্নু মিয়া। শুনানি শেষে ঢাকার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালত তাদের দুই জনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিও করা হয়েছে সংখ্যা উল্লেখ না করে। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশের জেরার মুখে এই হত্যাকা-ে শিমুকে হত্যার দায় স্বীকার করলেও নোবেলকে মামলায় আসামি করা নিয়ে তার শ্যালিকা ফাতেমা নিশা ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। নিশা বলেন, পুলিশকে কোন পরিপ্রেক্ষিতে আমার বোন জামাই নোবেল একথা বলেছে, তা পুলিশই জানে। হয়তো-পুলিশের কাছে তথ্যপ্রমাণও আছে। এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পারিবারিক বিষয় ও দাম্পত্য কলহের কারণে চিত্রনায়িকা ও মডেল রাইমা ইসলাম শিমুকে (৩৫) হত্যা করেছে তার স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল। এরপর শিমুর মরদেহ গুম করতে বস্তায় ভরে কেরানীগঞ্জে ফেলতে সহায়তা করেছে নোবেলের বন্ধু ফরহাদ। মরদেহ উদ্ধারের পর ঘটনাটি তদন্ত করে হত্যাকা-ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শিমুর স্বামী ও তার বন্ধুকে গ্রেফতার করেছে কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিমুর স্বামী নোবেল ও তার বন্ধু হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করেছে। সোমবার মরদেহ উদ্ধারের পরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খন্দকার সাখাওয়াত আলীম নোবেল ও তার বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুলাহ ফরহাদকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে আসা হয়। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের ফলে শিমুর স্বামী নোবেল ও তার বাল্যবন্ধু ফরহাদের হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। এজন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়। হত্যার কারণ সম্পর্কে এসপি মারুফ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে কলহ থাকায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় নোবেল। আর হত্যার পর লাশ গুমে সে বন্ধু ফরহাদের সহযোগিতা নেয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নোবেল তার স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সোমবার সকাল ১০টায় স্থানীয়ভাবে সংবাদ পেয়ে কেরানীগঞ্জ থানাধীন হযরতপুর ইউপির আলীপুর ব্রিজ থেকে ৩০০ গজ উত্তর পাশে বস্তাবন্দী অবস্থায় একটি মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহের সুরতহাল তথ্য প্রস্তুত করে মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়। সেটা পোস্টমর্টেমের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে মৃতদেহের নাম পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ সম্পর্কে এসপি মারুফ বলেন, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করে। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ শিমুর বাসায় যায়। এ হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা শুরু করে। খুনীরা যদিও খুবই পরিকল্পিতভাবে লাশটি কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন হযরতপুরে ফেলে যায় তবে তারা কিছু চিহ্ন রেখে যায়। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলামত জব্দ করি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভিকটিম নিহতের স্বামী খন্দকার সাখাওয়াত আলীম নোবেল ও তার বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদকে রাতেই কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে আসা হয়। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের ফলে তারা উভয়েই যে হত্যাকা-ে জড়িত তার প্রমাণ পাওয়া যায়। মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, দাম্পত্য কলহের জেরে রবিবার আনুমানিক সকাল ৭-৮ টার মধ্যে খুন হন শিমু। শিমুর লাশ গুমের চেষ্টায় যে গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি জব্দ করে থানায়। অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করেছি। তবে কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়টি এখনই বলা যাচ্ছে না। তদন্তের পর বলতে পারব। প্লাস্টিকের সূত্রে রহস্য উদ্ঘাটন ॥ এদিকে প্লাস্টিকের সূত্র ধরে এই হত্যা রহস্যের উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ। পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, লাশ উদ্ধারের পর তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে নিহত নারীর পরিচয় শনাক্ত করে পুলিশ। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে, পাশাপাশি অভিনেত্রী শিমুর বাসায় গিয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে। এ সময়ই একটি প্লাস্টিকের সুতার সূত্র ধরে উদ্ঘাটিত হয় হত্যার মূল রহস্য। লাশ গুম করতে দুটি বস্তা যে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল, সেই সুতারই হুবহু এক বান্ডিল শিমুর স্বামী নোবেলের গাড়িতে পাওয়া যায়। গাড়িটি ধোয়া ছিল এবং দুর্গন্ধ দূর করতে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোবেলকে আটক করে পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে শিমুর স্বামী জানান, পারিবারিক কলহের জেরে তিনি শিমুকে হত্যা করেছেন। রবিবার সকাল ৭টা-৮টার দিকে তিনি শিমুকে গলাটিপে হত্যা করেন। এরপর ফরহাদকে মুঠোফোনে কল কওে ডেকে নেন। পরে ফরহাদ ও নোবেল পরিকল্পনা করে বাইরে থেকে বস্তা এনে শিমুর লাশ লম্বালম্বিভাবে দুটি পাটের বস্তায় ভরে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করেন। এরপর বাড়ির দারোয়ানকে নাশতা আনতে বাইরে পাঠিয়ে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের আসনে শিমুর লাশ নিয়ে বেরিয়ে যান। প্রথমে নোবেল ও ফরহাদ মিরপুরের দিকে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে লাশ গুমের উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে তারা আবার বাসায় ফেরেন। ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আবার তারা লাশ গুম করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বছিলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার হযরতপুর ইউনিয়নের কদমতলী এলাকার আলীপুর ব্রিজের ৩০০ গজ দূরে সড়কের পাশে ঝোপের ভেতর লাশটি ফেলে চলে যান। তখন রাত সাড়ে নয়টা। শ্বাসরোধ করে হত্যা ॥ শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। এ বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, মৃত ওই নারীর গলায় দাগ দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে রশি অথবা এই জাতীয় কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তার শরীর থেকে ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া মৃত্যুর আগে ধর্ষিত হয়েছে কিনা ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে। ্এদিকে র‌্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, মরদেহ উদ্ধারের পর পরই গাড়িচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে র‌্যাবের কাছে তিনি কিছু তথ্য দেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্বামী নোবেল এ খুনের দায় স্বীকার করেছেন। তার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া খুনের আলামত প্রাইভেটকারের ব্যাক ডালায় রক্ত দেখা গেছে। প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়েছে। পারিবারিক সূত্রমতে- স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসায় থাকতেন শিমু। রবিবার সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে তিনি আর ফেরেননি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় রাতেই কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরদিন সোমবার কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ব্রিজের কাছে আলিয়াপুর এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে শিমুর বস্তাবন্দী খ-িত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শিমুর ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন রাতে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার বোনজামাই নোবেল প্রায়ই শিমুকে মারধর করতেন। তিনি মাদকাসক্ত। এর আগে সোমবার কেরানীগঞ্জ থেকে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুর বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মরদেহ রাখা ছিল রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। সেখানেই শিমুর স্বামী ও গাড়িচালক ফরহাদ গেলে তাদের আটক করে র‌্যাব। পুলিশ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই নিশ্চিত করেছে- শিমুকে হত্যা করে স্বামী নোবেল। কিন্তু লাশটি গুম করতে সহায়তা করেছে নোবেলের বন্ধু ফরহাদ। ঘাতক আমার দুলাভাই ॥ লাশ উদ্ধারের পর মুহূর্তেই এ জন্য শিমুর স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেলকে দায়ী করেছেন শিমুর বড় ভাই শহীদুল ইসলাম খোকন। তিনি বলেছেন- আমার বোনজামাই মাদকাসক্ত। প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হতো। অথচ সব কিছু নাটক সাজিয়ে শিমু রবিবার থেকে নিখোঁজ জানিয়ে কলাবাগান থানায় জিডি করেছিলেন নোবেল। মধ্যরাতে এক সংবাদ সম্মেলনে শিমুর ভাই খোকন বলেন, নোবেলের গাড়ির ভেতর রক্ত দেখেছি। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সে বাসায় ছিল না; সেই সময়ের মধ্যে সে লাশ ফেলে দিয়েছে। স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর গ্রীন রোড এলাকার একটি বাসায় থাকতেন ৪০ বছর বয়সী শিমু। সোমবার কলাবাগান থানায় করা জিডিতে তার স্বামী নোবেল বলেছিলেন, মাওয়ায় শূটিংয়ের কথা বলে রবিবার সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি তার স্ত্রী। তবে খোকনের অভিযোগ করেছেন ওই বাসাতেই তার বোনকে খুন করা হয়েছে। পরে লাশ সরিয়ে নেয়া হয়েছে নোবেলের গাড়িতে করে। ওই গাড়িও পুলিশ জব্দ করেছে। আমার বোন যে কাপড় পরে ছিল, সেটা পরে কোনদিন সে বের হয় নাই। এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি আবু সালাম মিয়াও বলেছিলেন, অন্য কোথাও হত্যার পর লাশ টুকরো করে বস্তায় ভরে গাড়িতে করে আলিয়াপুর এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তাদের মনে হয়েছে। কলাবাগান থেকেই নোবেল ও ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেছেন-হত্যা সংক্রান্ত বেশ কিছু আলামতও আমরা পেয়েছি। কল্পনাই করতে পারিনি ॥ নিহতের বোন ফাতিমা নিশা বিশ্বাস করতে পারছেন না তাকে এভাবে হত্যা করা হবে। তার ভাষায় এটা ছিল কল্পনাতীত। এমনটি চিন্তাও করতে পারেননি কখনও। এ বিষয়ে তিনি মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, গত পরশু রবিবার সন্ধ্যার দিকে আমার কাছে একটি ফোন আসে আমার বোন অভিনেত্রী রাইমা ইসলামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখন আমার বোনের ফোন নাম্বারে বারবার কল দেই। নাম্বার বন্ধ পাচ্ছিলাম। পরে আমি আমার বোনের মেয়েকে ফোন দেই। বলি, তোমার আম্মু কোথায়? সে আমাকে বলে, মা সকালে একা বের হয়েছে এখনও বাসায় ফেরেনি। তারপর আমি আমার বোনের স্বামী সাখাওয়াত আলীম নোবেল ভাইকে ফোন দেই। তাকে ফোন দিয়ে বলি- ভাইয়া, দিদি কোথায়। তার ফোন তো বন্ধ পাচ্ছি। তখন তিনি আমাকে বলেন-আমিতো জানি না। এছাড়া সারাদিনে আমি তাকে ফোন দেইনি। তার নাম্বার যে বন্ধ সেটাও আমি জানি না। ফাতেমা বলেন- ওর খুব কাছের একজন বন্ধু কল করে আমাকে জানায়-শিমুকে অনেকক্ষণ ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সে আমার কাছে জানতে চায়, আমার সঙ্গে শিমুর কথা হয়েছে কিনা। আমি বলি, না, আমার সঙ্গে কথা হয় নাই। মেসেঞ্জারে কল করেছিলাম, কিন্তু ধরেনি। এরপর থেকে শিমুর ফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যে আমি, আমার ভাই, তার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে গেছি। অনেক জায়গায় ফোন করেছি, কারও সঙ্গেই কথা হয় নাই। ওর ক্লোজ একটা বান্ধবী আছে, যার নাম আনমন, ওনাকে কল দিলাম, বললাম বিষয়টা। তারপর আনমন আমাকে জানান, তিনি রবিবার সকালে ১০টা ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে শিমুকে কল করেছিলেন। ফোন খোলাও পাওয়া গেছে, কিন্তু রিসিভ করেননি। এ অবস্থায় রাত ১১টার দিকে কলাবাগান থানায় চলে যান ফাতেমা নিশা। বোন শিমু নিখোঁজ জানিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল, মিটফোর্ড হাসপাতালে খবর নেন তারা। কিন্তু কোন হদিস মেলেনি। ফাতেমা বলেন, আমরা ভোর থেকেই আবার বোনকে খোঁজা শুরু করি। একসময় পুলিশের এসআই আমাদের জানান, শিমুর ফোন বন্ধ হয়েছে রবিবার সকাল ১০টা ২৬ মিনিটে। আসলে আমার ধারণার সঙ্গে মিলে যায় ফোন বন্ধের হিসাবটা। রবিবার শিমু বাসা থেকে বের হয় সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। ফোনটাও অফ হয়েছে ওই টাইমে। আসলে পুলিশ শিমুর শেষ অবস্থান জানাতে পারেনি। এর মধ্যে আমি র‌্যাবে, ডিবি ও সন্ধ্যায় সিআইডিতে কথা বলি। সন্ধ্যায় আমাদের একজন ফোন করে বলেন লাশ পাওয়া গেছে। তাকে কেউ হত্যা করে এভাবে বস্তাবন্দী অবস্থায় ফেলে রেখে যাবে আমরা একটা কল্পনাই করতে পারছি না। আমার একমাত্র বোন সে। শিমুর স্বামী নোবেলের ওপর তাদের কোন সন্দেহ আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের ১৮ বছরের সংসার জীবন। নোবেল ভাই আমার বোনকে হত্যা করেছে এটা আমরা চিন্তা করি না। তার বিষয়ে এরকম চিন্তা ভাবনা আমাদের মাথায় আসতেছে না। থানায় বসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আসলে এমন কোন দিন নেই যে বোনের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। আমার বোনের স্বামী তাকে মেরেছে কিনা, সেটি আমরা জানি না। ১৮ বছরের সংসারে তাদের মধ্যে পারিবারিক কিংবা অন্য কোন বিষয় নিয়ে কলহ দেখিনি। আমি শিমুর স্বামীর সঙ্গে কথা বলব। তাকে জিজ্ঞাসা করব, কেন আপনি হত্যাকাণ্ডটি করেছেন? ভালবেসে বোনকে বিয়ে করেছিলেন। ১৮ বছরের সংসার আপনাদের। বোনের অপরাধটা কী ছিল? ফাতেমা বলেন-আমার বোনজামাই নোবেল যেটা বলল, রবিবার সকালে তাকে শিমু ডাক দিয়ে বলেছে, তুমি ওঠো বাজারে যাব। বুয়া আসলে তুমি বলবা যে আধাঘণ্টা পরে আসতে। কিন্তু শিমু আর বাজারে যায়নি। কিছুক্ষণ পরে তার স্বামীকে বলে-আমি একটু মাওয়া যাব, দেরি হতে পারে। এটা বলে বের হয়ে গেছে। ফাতেমা জানান, তার সঙ্গে প্রতিদিনই কথা হতো শিমুর। কিন্তু তাদের পরিবারে কোন দ্বন্দ্ব-কলহ আছে কিনা সে বিষয়ে কখনও কথা হয়নি। তিনি বলেন-আমাকে এভাবে কিছু বলে নাই যে কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব আছে কিনা। সে তো মিডিয়াকর্মী। আমার সঙ্গে প্রতিদিনই কথা হতো, কিন্তু থাকে না যে হার্ড দ্বন্দ্ব এ রকম কোন কিছু কখনও বলেনি। কাজের ক্ষেত্রে অনেকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। সেটা অন্য ইস্যু, ওদের এফডিসিতে যেটা চলে, সেটা অন্যরকম। শিমু একদিনও বলেনি জায়েদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়েছে। এটা ভুল-বোঝাবুঝির কারণে ঘটছে। মঙ্গলবার সারাদিনই থানায় ছিলেন শিমুর বোন নিশা ও তার বড় ভাই শহিদুল ইসলাম । দিনভর তারা মিডিয়ায় কথা বলেছেন। শহিদুল ইসলাম বলেন, পেশাগত জায়গায় আমার বোনের কিছুটা ক্ষোভ ছিল। তার মানে এই নয়, সেই ঘটনায় খুন হয়েছে। ঘটনাটা আড়াল করতে জায়েদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন কেউ কেউ। এ হত্যার সঙ্গে আমার বোনজামাই দায়ী। তিনি আমার বোনের গায়ে হাত তুলতেন। ঝগড়া করতেন। তিনি বলেন, করোনার মধ্যে হঠাৎ এই চিত্রনায়িকাকে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সদসদ্যপদ হারানো ১৮৪ জনের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। তিনি ছিলেন ভোটাধিকারবঞ্চিত চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক। ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে এফডিসির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন অন্য সহকর্মীসহ। সে সূত্রে সোমবার রাত থেকেই গুজব ছড়ায়- ঘটনার সঙ্গে জায়েদ খান জড়িত থাকতে পারেন। এ কথা জায়েদের কানেও গেছে। কে এই শিমু ? ॥ দুই দশক আগেও কেরানীগঞ্জের ওই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল আলোচিত মডেল তিন্নীর লাশ। সোমবার শিমুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধারের পর থেকেই সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিয়েেেছ। অনেকের মনেই প্রশ্ন- কে এই চিত্রনায়িকা রাইমা ইসলাম শিমু। এ বিষয়ে চলচ্চিত্র সূত্রেও জানা যায়, ১৯৯৮ সালে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে বরিশালের মেয়ে রাইমা ইসলাম শিমুর। তার প্রথম সিনেমা কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘বর্তমান’। যেখানে তিনি অভিনয় করেন তখনকার জনপ্রিয় তারকা মান্না, মৌসুমী, ডিপজল প্রমুখের সঙ্গে। এরপর ছয় বছরে একে একে অভিনয় করেছেন ২৩টিরও বেশি সিনেমায়। তবে সবশেষ তাকে দেখা গেছে ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জামাই শ্বশুর’ সিনেমায়। ফলে এই সময়ের দর্শকদের কাছে তিনি ততটা পরিচিত নন। তবে গত কয়েক বছর ধরে শিমু নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিনয় করেছেন প্রায় ৫০টি নাটকে। সাম্প্রতিক আলোচিত নাটক ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’-এও অভিনয় করেছেন তিনি। পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তার নিজের প্রোডাকশন হাউজ ছিল। মাঝে মধ্যে পরিচালনাও করতেন এই নায়িকা। তিনি বাংলাদেশের অনেক গুণী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম, দেলোয়াার জাহান ঝন্টু, দেওয়ান নজরুল, এ জে রানা, শরিফুদ্দিন খান দীপু, ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম, স্বপন চৌধুরী, এনায়েত করিম, শবনম পারভীন। অভিনয় করেছেন রিয়াজ, অমিত হাসান, বাপ্পারাজ, জাহিদ হাসান, মোশারফ করিম, শাকিব খানসহ অনেক গুণী ও জনপ্রিয় অভিনেতাদের বিপরীতে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকে বাদ পড়া ১৮৪ সদস্যদের একজন ছিলেন শিমু। ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলনে তিনি ছিলেন বেশ সক্রিয়। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে শিমু রাজধানীর গ্রীন রোড এলাকার বাসায় থাকতেন। সিনেমার পাশাপাশি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন শিমু। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যামিলি ক্রাইসিস নামে একটি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন। ২৩টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ৫০টিরও বেশি নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাও করেছেন তিনি। তার ফেসবুক পেজে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি বাণিজ্য বিষয়ক সাময়িকী, একটি বেসরকারী টেলিভিশনের বিপণন বিভাগে কাজ করার পাশাপাশি একটি প্রোডাকশন হাউজও চালাতেন শিমু।
×