
খেলতেন ভলিবল, যোগ দিলেন বিমানবাহিনীতে, হয়ে গেলেন ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের নায়ক! এবাদতের গল্পটা ইন্টারেস্টিং। পেসার হান্টের মাধ্যমে উঠে আসা বাংলাদেশী তরুণ এক লহমায় বিশ্ব ক্রিকেটের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে অবিস্মরণীয় নিউজিল্যান্ড বধের নায়ক তিনি। ঘরের মাঠে ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা কিউইদের মাটিতে নামিয়ে আনলেন মৌলভীবাজারের সন্তান। ২৮ বছর বয়সী কাঁপিয়ে দিলেন, নাড়িয়ে দিলেন রথি-মহারথীদের হৃদয়। উইল ইয়াং, ডেভন কনওয়ে, রস টেইলর, হেনরি নিকোলস, টম ব্লান্ডলকে ফিরিয়ে ভেঙ্গে দিলেন কিউইদের ব্যাটিংয়ের কোমর। একেকটি শিকার কমান্ডো কায়দায় একেকটি স্যালুট। ২১ ওভারে ৬ মেডেন, ৪৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট। প্রথম ইনিংসে একটি। ৮ উইকেটের জয়ে ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা। ভারত, পাকিস্তানের মতো উপমহাদেশের পরাশক্তিও যেখানে গিয়ে বছরের পর বছর খাবি খেয়ে এসেছে, সেখানে এক দশকেরও বেশি সময় পর টেস্টের নাম্বার ওয়ান নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে টাইগারদের ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের পুরোধা এবাদত। বিদেশী পত্রিকা শিরোনাম করল, ‘স্যালুট ম্যানকে ক্রিকেট বিশে^র স্যালুট!’ লাইমলাইটে আসতে আর কী লাগে!
অথচ ক্রিকেটার এবাদতের গল্পটা এমন মসৃণ নয়। বে ওভালে নামার আগে লজ্জার এক রেকর্ড সঙ্গী ছিল তার দখলে। সবচেয়ে বাজে এ্যাভারেজের টেস্ট বোলারদের তালিকায় ওপরের দিকে ছিল তার নাম। চতুর্থ দিনে ৪ উইকেট নিয়ে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডার ধসিয়ে দিয়েছিলেন ইবাদত। তার আগুন ঝড়ানো বোলিংয়েই কিউইদের মাঠে প্রথম জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাংলাদেশ। পঞ্চম দিনে এসে দ্বিতীয় ওভারেই রস টেইলরকে বোল্ড করে ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম পাঁচ উইকেট পূর্ণ করেন টাইগার এই পেসার। ছয় নম্বর শিকার কাইল জেমিসনকে রানের খাতাই খুলতে দেননি। টেস্ট ক্যারিয়ারে তার প্রথম তো বটেই, প্রায় ৯ বছর ও ৪৭ টেস্ট পর টেস্টে ৫ উইকেটের স্বাদ পেলেন বাংলাদেশের কোন পেসার। ইবাদত থামেননি সেখানেই। পরের ওভারেই ফিরিয়ে দেন কাইল জেমিসনকে। পরে তাসকিন আহমেদ ও মেহেদী হাসান মিরাজ মিলে শেষ করে দেন নিউজিল্যান্ড ইনিংস। ইবাদত ততক্ষণে পৌঁছে যান রেকর্ড উচ্চতায়। ৪৬ রানে ৬ উইকেট তার, দেশের বাইরে বাংলাদেশের কোন পেসারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে এর চেয়ে ভাল বোলিং ফিগার আছে কেবল আরেকজন পেসারের। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রামে ২৭ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন শাহাদাত হোসেন।
২০১৩ সালে এপ্রিলে জিম্বাবুইয়ে সফরে পরপর দুই টেস্টে অসাধারণ সুইং বোলিংয়ের প্রদর্শনীতে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন রবিউল ইসলাম। এরপর বাংলাদেশের আর কোন পেসার পারছিলেন না এই মাইলফলক ছুঁতে। এই সময়টায় ৩ দফায় ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন আবু জায়েদ চৌধুরি, দুবার করে মুস্তাফিজুর রহমান ও তাসকিন আহমেদ। কিন্তু ৫ উইকেট আর হচ্ছিল না। অবশেষে ইবাদতের হাত ধরে কাটল সেই খরা। অথচ মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে এই টেস্টের আগে তার উইকেট ছিল ১০ টেস্টে স্রেফ ১১টি। বোলিং গড় ছিল ৮১.৫৪, ১০টির বেশি উইকেট শিকারিদের মধ্যে টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে গড় যা। সেই তিনিই এবার উপহার দিলেন অসাধারণ বোলিং। ইবাদতের এই স্বপ্নযাত্রা শুরু হয় চতুর্থ দিন দ্বিতীয় সেশনে। টানা ৯ ওভারের স্পেলে ২৩ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট। এরপর শেষ সেশনে অসাধারণ এক স্পেলে তিনি ঘুরিয়ে দেন ম্যাচের মোড়ই। ৭ বলের মধ্যে ৩ উইকেট নেন ওই স্পেলে। সব মিলিয়ে স্পেলটি ছিল ৭-৩-১৫-৩। ৪ উইকেট নিয়ে শেষ দিন শুরুর পর আরেকটি উইকেটের জন্য অপেক্ষা খুব একটা করতে হয়নি। দিনের দ্বিতীয় আর নিজের দ্বিতীয় বলেই ধরা দেয় সেই উইকেট। ভেতরে ঢোকা দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড করে দেন অভিজ্ঞ টেইলরকে। ষষ্ঠ শিকার জেমিসন আউট হন শর্ট মিড উইকেটে শরিফুল ইসলামের দুর্দান্ত ক্যাচে।
বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ৫ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব আগে ছিল স্রেফ ৪ জন পেসারের। সর্বোচ্চ ৪ বার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন, রবিউল ইসলাম ২ বার। একবার করে মঞ্জুরুল ইসলাম ও রুবেল হোসেন। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের কোন পেসারের ৫ উইকেট ছিল একটি। ২০১০ সালে হ্যামিল্টনে বেদম মার খেয়ে ১৬৬ রানে ৫ উইকেট নিতে পেরেছিলেন রুবেল হোসেন। ইবাদত এবার তাকে পেছনে ফেললেন অনেকটা ব্যবধানে। এই জায়গায় আসাটা এত সহজ ছিল না। হয়ত বা ক্রিকেটারই হতে পারতেন না। সেটা কেবল সম্ভব হয়েছে তার অদম্য ইচ্ছা আর অসম্ভব একটি সুন্দর স্বপ্নের কারণে। এবাদত জানান, ‘ভলিবল থেকে ক্রিকেটে আসার গল্পটা অনেক লম্বা। আমি ক্রিকেটটা উপভোগ করছি। বাংলাদেশ ও বিমানবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করাটাও।’ মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন এবাদত হোসেন। আগে পাড়ার মাঠে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট খেলতেন। বাবা চাকরি করতেন বিজিবিতে। বাবার দেখানো পথেই হাঁটলেন এবাদত। ২০১২ সালে যোগ দেন বিমানবাহিনীতে। নিয়মমাফিক জীবনের মাঝে সুখ খুঁজতে গিয়েও আবিষ্কার করলেন এটি তার জন্য নয়। খেলার মাঠ এবাদতকে খুব টানে। যে কারণে ছকে বাঁধা জীবনে চাকরির পাশাপাশি চলছিল খেলাধুলাও; ভলিবল, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল এসব। এরপর বিমানবাহিনীর নিয়মিত ভলিবল খেলোয়াড় হয়ে যান।
কিন্তু ভলিবলেও নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। কারণ তার মন পড়ে থাকে ক্রিকেট মাঠে। তার প্রতিষ্ঠান বিমানবাহিনীও এবাদতের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসে। তার খেলাধুলায় বাধা দেয় না। যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে ক্রিকেটে নিজেকে জড়াতে শুরু করেন। ২০১৪ সালে সিটি ক্লাবের হয়ে ঢাকায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলার সুযোগ পান এবাদত। ক্রিকেটে পরিচিত হতে থাকেন ধীরে ধীরে। ২ বছর পর সামনে চলে আসে সুবর্ণ সুযোগ। ২০১৬ সালে রবির সহযোগিতায় বিসিবি আয়োজন করে পেসার হান্টের। সারাদেশ থেকে প্রতিভাবান পেসারদের তুলে আনার লক্ষ্য নিয়ে এই পেসার হান্টের আয়োজন করে তারা। এখানেই নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে যান এবাদত হোসেন। প্রথমে ঢাকা থেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ফরিদপুর গিয়ে পেসার হান্টে অংশ নেন। এবাদতের পাশাপাশি প্রায় ১৪ হাজার ৬৪১ প্রতিযোগী নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করতে সেখানে যান। এত মানুষের ভিড়ে শুধু দুটি বল করার সুযোগ পান তিনি। যেখানে একটি বল করলেন ১৩৯.০৯ কিলোমিটার গতিতে। এই দুটি বল করেই নির্বাচকদের নজর কাড়েন।
পেসার হান্টে নির্বাচিত হওয়ার পর পরবর্তী ধাপে পরীক্ষা দিতে এবাদত চলে আসেন ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে। এখানে পেসারদের নির্বাচিত করার কাজ ছিল পাকিস্তানের সাবেক পেসার আকিব জাবেদের। বলের গতি দিয়ে কোচদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন বিমানবাহিনীর এ তরুণ। এমনকি সর্বশেষ প্রায় লক্ষাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে পেসার হান্টে প্রথম হলেন তিনি। প্রায় ৬৩ জনকে বাছাই করা হয় প্রতিযোগিতাটি থেকে। এই কজনের মধ্যে ১৩৯ কিলোমিটার গতিতে বল করে প্রথমস্থান অধিকার করেন এবাদত। এরপর তিনি চলে আসেন হাই পারফরমেন্স দলের হয়ে ট্রেনিং করতে। আকিব জাবেদও এবাদতকে নিয়ে গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে যান। ২০১৯ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ড সফরে হ্যামিল্টন টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। ১১ টেস্টে নিয়েছেন ১৮ উইকেট।