ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বার্ধক্যের পরিচর্যা

প্রকাশিত: ০০:১৩, ১১ জানুয়ারি ২০২২

বার্ধক্যের পরিচর্যা

সাধারণত ৬৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সের ব্যক্তিদের বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক, মানসিক, কখনও পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক অবস্থানগত অল্প-বিস্তর তথাপি অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক সময় যারা আমাদের লালন-পালন করেছেন তাঁদের প্রতিই কালের পরিক্রমায় একটা পর্যায়ে যথাযথ ধৈর্যশীল ও যতœবান হওয়াটা আবশ্যক হয়ে যায়। সময়ের স্রোতে মানুষের শরীরযন্ত্রে এবং মনোজগতে ভিন্নতা আসে, রূপ বদল হয়। এই পরিবর্তনগুলো অনেকাংশে স্বাভাবিক হলেও নানাবিধ অসুবিধাও এ সময় দেখা দিতে পারে যাকে সাধারণভাবে অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গসমূহ অতিরিক্ত শারীরিক দুর্বলতা, ওজনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন, ক্ষুধামন্দা। শরীরে ব্যথা, বিভিন্ন হাড়ে-জয়েন্টে ব্যথা (যেমন কাঁধে, হাঁটুতে), কোমড়ে ব্যথা। মুখে, পেটে, পায়ে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া। চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া, ছানি পড়া। শরীরের এক বা একাধিক স্থানে চাকা অনুভূত হওয়া। হাত-পা জ্বালাপোড়া করা বা বোধশক্তির কোন লক্ষণীয় পরিবর্তন। পেটে ব্যথা, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া বা অন্য কোন সমস্যা পরিলক্ষিত হওয়া। কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট হওয়া; বিশেষত যাদের দীর্ঘকাল ধূমপানের ইতিহাস রয়েছে কিংবা যেসব নারীরা রান্নার জন্য লাকড়ির চুলা ব্যবহার করেন তাঁরা ফুসফুসের রোগের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকেন। শীতকালে সাধারণত হাঁপানি রোগ ও ফুসফুসে প্রদাহজনিত সমস্যা বেড়ে যায়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হওয়া, প্রস্রাব ধরে রাখতে অসুবিধা বোধ করা, প্রস্রাবের পরিমাণ বা রঙে কোন পরিবর্তন আসা। বারবার জ্বর আসতে থাকা। চামড়ায় কোন বিশেষ পরিবর্তন কিংবা চুলকানি দেখা দেয়া। মাথা ঘুরানো, ঝিমঝিম লাগা, হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া অথবা অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলা কিংবা খিঁচুনি। মাথাব্যথা, বমি, শরীরের কোন পাশে বোধশক্তি কম পাওয়া অথবা দুর্বল লাগা। কথা বলতে সমস্যা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া। বুক ধরফর করা, বুকে ব্যথা অনুভব, কিছুক্ষণ হাঁটার পর বুকে ব্যথা বাড়া কিংবা পায়ের মাংশপেশিতে ব্যথা হওয়া। ঘুমের সমস্যা, মানসিক অস্থিরতা, স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়া। মন-মেজাজের অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়া কিংবা আবেগ বা ভাব প্রকাশের অস্বাভাবিক/আকস্মিক পরিবর্তন। করণীয় সুষম খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের জন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতাও কাম্য। ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করতে হবে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হলেও হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রয়োজনের অধিক ওষুধ সেবন থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা ভাল। তা না হলে নানাবিধ জটিলতা দেখা দিতে পারে। অপরপক্ষে, জীবণরক্ষাকারী বা অত্যাবশকীয় কোন ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ রাখাও ক্ষতিকারক। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, বাতের সমস্যা, হাঁপানি থাকলে এ সকল রোগের তীব্রতা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উত্তম। চিকিৎসার পাশাপাশি মাঝেমাঝে রক্তে সুগার ও ব্লাড প্রেশার মেপে দেখা দরকার। দীর্ঘমেয়াদী কিডনিরোগ, লিভাররোগ, ফুসফুসের সমস্যা ইত্যাদি থাকলে নিয়মিতভাবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করা জরুরী। ক্ষেত্রবিশেষে টিকা গ্রহণ করা অসুস্থতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ক্যান্সারের রোগীদের নির্ধারিত চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর মনোবল বৃদ্ধিতে পরিবারের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। যদি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার দরুন বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহৃত হয় তাহলে সেই বাসার অভ্যন্তরে সকলের জন্যই ধূমপান পরিত্যাজ্য। এমনকি রান্নার জন্য বা অন্যান্য দরকারে আগুন জ্বালানোর কাজেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় পরপর নাকে নল দিয়ে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সর্বদা রোগীকে বসিয়ে নিতে হবে। মাথা উঁচু না করে খাবার দিলে তা ফুসফুসে গিয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। শয্যাশায়ী রোগীদের অবশ্যই দুই ঘণ্টা অন্তর পাশ পরিবর্তন করে দিতে হবে, সম্ভব হলে নিউম্যাটিক বেড ব্যবহার করলে ভাল। কেননা দীর্ঘক্ষণ একইভাবে শুয়ে থাকার ফলে চাপের জন্য এসব রোগীদের পিঠে, কোমরে বা পায়ের গোড়ালিতে ঘা দেখা দিতে পারে যা কিনা পরবর্তীতে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে জটিলতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও একইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শোয়ায় রাখলে রোগীর রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে জীবনহানির কারণ হতে পারে। সম্পূর্ণভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল রোগীর পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন, ধৈর্যশীল ও কাজের প্রতি সচেতন থাকতে হবে। বাসার বাথরুম ও শোবার কক্ষসহ অন্যান্য ঘরের মেঝে যেন পিচ্ছিল হয়ে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বয়সভেদে রোগের উপসর্গের তারতম্য বিদ্যমান। তাই বয়সবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে দীর্ঘদিন রোগ পুষে রাখার মতো বিপজ্জনক মনোভাব বা উদাসীনতা থেকে সরে এসে যে কোন সমস্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করাই শ্রেয়। কোন অসুবিধা দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যথাসময়ে গ্রহণ করা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, বার্ধক্যে উপনীত হলেও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকতে একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য নিজের মধ্যেই শারীরিক প্রচেষ্টা ও মানসিক প্রবৃত্তি রাখা অপরিহার্য। সুতরাং সেভাবে সবসময় সচেষ্ট থাকতে হবে। এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, এই বৃদ্ধ মানুষেরা আমাদের সম্পদ। তাঁদের প্রতি আমাদের কোনরূপ অবহেলা বা অযাচিত আচরণ আদৌ কাম্য নয়। আজীবন আমাদের আগলে রাখা দায়িত্বশীল বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির প্রয়োজনে পাশে থাকাটাই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। আজ যারা যৌবন বা প্রৌঢ়ত্বে আছে তারাই আগামীর বৃদ্ধজন। তাই এই মানুষদের প্রতি মূলত আমাদের ভালবাসা, সচেতন মনোভাব ও সজাগ দৃষ্টি তাঁদের সুস্বাস্থ্যের প্রধান পাথেয়। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, গ্রীন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা চেম্বার : ম্যাটাডোর ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা
×