ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শীত মৌসুমের চিরন্তন লোককাল শুরু

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০২১

শীত মৌসুমের চিরন্তন লোককাল শুরু

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর প্রতিটি ঋতুর লোকায়তকাল বা লোককাল আছে। শীতের লোককালের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের বেশিরভাগ ধারা যা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। একবিংশ শতকে অতীতের সুখস্মৃতির ডালা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে লোকজ সংস্কৃতি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাস’। বাঙালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভা-ার সমৃদ্ধ। শীতের সময়টায় গ্রামীণ আবহ ঢাকা থাকে কুয়াশার আচ্ছাদনে। রাতে শিশির ঝরার নীরব শব্দ কানে বাজে। পূর্ণিমার মায়াবি ভরাচাঁদ ¯িœগ্ধ আলোয় ভরিয়ে দেয় ভুবন। প্রকৃতির এই মধুময়তায় সৃষ্টি হয় লোকজ ধারা। যা বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসের গভীরে থেকে উৎসারিত। আনুষ্ঠানিকতার শীত মৌসুম শুরু হতে এখনও দিন কয়েক বাকি। এর মধ্যেই শীত জেঁকে বসার পালা শুরু করেছে। আবহাওয়াবিদগণ কখনও বলছেন এবার শীত বেশি হবে। কখনও বলছেন-ঠিক বলা যাচ্ছে না। তাহলে আর কী হলো! শীত কম হোক বেশি হোক শীতকালের লোকজ সংস্কৃতির অধ্যায়ের কোন কম বেশি নেই। অগ্রহায়ণে নবান্ন হয়েছে। ধান মাড়াই কাটাই চলছে। প্রযুক্তির কৃষি সবই যন্ত্রে। লোকজ ধারার সেই চিত্র উধাও। কামলা কিষানের সারিবদ্ধ বসে কাঁচি দিয়ে ঘচাং ঘচাং শব্দে ধান কেটে আঁটি করে রাখা। কণ্ঠে ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি সুর। দিনের শেষে কেউ সেই আঁটি ভারে তুলে নিয়ে যায় আঙ্গিনায়। বড় গৃহস্থ ঘরের কিষান গরুর গাড়িতে আঁটি তুলে নিয়ে যাওয়া। গরু টানতে না পারলে গাড়িয়াল ‘হ্যেই হ্যেই হাইট হাইট’ শব্দে পিঠে বসিয়ে দেয় পান্টির (ছোট কঞ্চি লাঠি) দুই তিন ঘা। গরু আঘাত পাওয়ার শব্দ না করলেও গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ বেদনার সুর তোলে। অতীতে ধান মাড়াই হতো আঁটি গোল করে সাজিয়ে গরু দিয়ে ঘুরিয়ে খুঁচিয়ে। এই লোকজ সংস্কৃতি উধাও। অতীতের এই সৃষ্টি লোককাল। শীতের পিঠাপুলি বাঙালীর চিরন্তন ঐতিহ্য। বাঙালীর গর্বের এই ধারা এখন গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। গাঁয়ের বধূ মাটির পাতিলে চিতই পিঠা, দুধপিঠা, পাটিসাপটা, কুশলী পিঠা (কোথাও বলা হয় কুলি পিঠা), ভাপা পিঠা কোন গ্রামে বলা হয় ভাগা পিঠা), তেল পিঠা, গড়গড়ি পিঠা কত যে পিঠা। পিঠাপুলির সংস্কৃতি নগরীতে এসেছে আধুনিকায়ন হয়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে পিঠা উৎসবের। বাঙালী সংস্কৃতির এই চিরন্তন ধারা হাজার বছর আগেও ছিল হাজার বছর পরেও থাকবে। কত সমৃদ্ধ বাঙালীর লোককাল। বাঙালীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম ধারা- আদিম কাল, মধ্য কাল ও আধুনিক কাল। প্রতিটি কালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে বাঙালীর গর্ব লোককথা, লোকজ ধারা বা লোকজ সংস্কৃতি। একের সৃষ্টি অন্যের বা গোষ্ঠীর কাছে অনুকরণীয় হওয়া সংস্কৃতি। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সংগৃহীত ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ প্রকাশিত হলে সুদূর পশ্চিমের সাহিত্য রসিক রোমাঁরোলাঁ মুগ্ধ হয়েছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় ‘বাংলার প্রতিটি পল্লীর মাঠে ঘাটে, পল্লীর আলো বাতাসে পল্লীর পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে। পল্লীর এই সাহিত্যের নাম লোকসাহিত্য। লোক সংস্কৃতি সর্বকালের কৃষি সমাজের সৃষ্টি।’ ড. তুষার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : অনগ্রসর কৃষি সমাজ বা পল্লী জীবন হচ্ছে লোকসংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্র। এই ধারা নানা বর্ণে নানা রূপে লোকজ রসসুধা তৈরি করে সমুখপানে অগ্রসর হয়। লোকসংস্কৃতির ইংরেজী আধুনিক নাম ‘ফোকলোর’ সৃষ্টি ১৮৪৬ সালে। এর আগে লোকসংস্কৃতিকে বলা হতো ‘পপুলার এ্যান্টিকুইটিজ’ (জনপ্রিয় পুরাতনী)। ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে ফোকলোরের দুই ভাগ। লোকশিল্প ও লোকসাহিত্য। লোকশিল্পের মধ্যে আছে- লোকপ্রথা, লোকভাস্কর্য, লোকবাদ্যযন্ত্র। লোকসাহিত্যের মধ্যে আছে- লোককথা, রূপকথা, ধাঁধাঁ, মন্ত্র, ছড়া, খেলার ছড়া, জায়গার নাম, লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, গীতিকা, গীতি, কিংবদন্তি, পুরাণ কাহিনী ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ শাখা লোকগীতি, যা সাহিত্যের আদি সৃষ্টি। লোকগীতিরই একটি শাখা গীত। পরবর্তী সময়ে এই গীত নারীর কণ্ঠেই অলঙ্কৃত হয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সুখ দুঃখ, প্রেম, বিরহ, আনন্দ বেদনার ভাষা হৃদয়ে লালিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনেক জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, বিরুয়া, হেরায়া ইত্যাদি। এগুলোতে আবেগ উচ্ছ্বাস দুঃখ বেদনার চিত্রগুলোই সাহিত্যগুণে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তবে ভাষার ক্ষেত্রে এগুলো ধারণ করেছে আঞ্চলিক স্বকীয়তা। এদিকে গীত ও গীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ এক হলেও গীত বলতে সাধারণত মেয়েদের কণ্ঠের গীত বোঝায়। গীতি মেয়ে পুরুষ উভয়ের কণ্ঠে গাওয়া গান। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েরা গীত গেয়ে অনুষ্ঠানকে আকর্ষণীয় করে তোলে। বিয়ের প্রতিটি ধাপেই গীত আছে। আবেগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, বেদনা বর ও কনেপক্ষের পরস্পরের প্রতি বিদ্রƒপাতœক কৌতুক, নক্সা কথার মাধূর্যে ও সুরে গীত হয়ে আকর্ষণীয় করে তোলে। গীতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো: এলাকা ও অঞ্চল ভেদে ভাষার ভিন্নতা থাকে। তবে কথা, অর্থ ও সুর কাছাকাছি। গীত শুনে মনে হবে বর ও কনে পক্ষের মধ্যে রীতিমতো বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। নানি দাদির গীত এক রকম, খালা ফুপুর গীত আরেক রকম। শ্যালিকাদের গীত শুনে মনে হবে যত দাবি দাওয়া আছে তা পেশ করা হচ্ছে বরের কাছে। বিয়ে অনুষ্ঠানের কনের বাড়ির শেষের পর্যায়ের গীত অনেকটাই বেদনার। কনে ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে স্বামীর ঘরে। যে ঘর তার কাছে নতুন। স্বামীর ঘরের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয় গীত। বরের বাড়িতে আরেক ধরনের গীত। কনে বরণ করে নেয়ার আনন্দের গীত। বিয়ের গীতের পাশাপাশি বাঙালীর নানা আনুষ্ঠানিকতায় পার্বণেও গীত গাওয়া হয়। আবার ঋতুভিত্তিক গীত আছে। বর্ষায় বৃষ্টি না হলে খরা দেখা দিলে বৃষ্টির জন্য গীত তৈরি হয়। কোথাও বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করে গীত হয়। বাঙালীর সমাজ জীবনে গীতের আবেদন চিরন্তন। শুধু গ্রামেই গীত হয় না। শহুরে জীবনে এই লোকজ ঐতিহ্য প্রবেশ করেছে। যা প্রমাণ করে বাঙালীর সংস্কৃতির শিকড় কতটা গভীরে। লোকজ বাঙালীর চিরন্তন গর্ব।
×