ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র ডাঃ

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র ডাঃ

একাত্তরে বাংলাদেশের নয় মাসের যে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম; তার গতিপ্রকৃতি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে। কখনও মুক্তিবাহিনী এগিয়েছে তো পিছিয়েছে কখনও। একাত্তরের ডিসেম্বরেই আছে এমনি একাধিক উদাহরণ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে সঙ্গত কারণেই সবচাইতে গৌরবের দিন। তেমনি ডিসেম্বরেই আছে শোকাবহ ১৪। এই ডিসেম্বরের আরেকটি অনন্য তারিখ ৬। আজ ৬ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনটিতেই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সর্বাগ্রে স্বীকৃতি দেয় ভারত এবং তার পরপরই ভুটান। ১৬ ডিসেম্বর তারিখটি তাই শুধু আমাদের কাছেই গর্বের নয়, এই গর্বের সমান অংশীদার ভারতও। কারণ, যে অদ্ভুতুড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বে¡র ভিত্তিতে ভারতকে ত্রিখ-িত করে ’৪৭-এ যে পাকিস্তানের সৃষ্টি, তা যে কতটা ব্যর্থ আর অকার্যকর, সেটিই প্রমাণিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বেলায় ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাই ভারতের বিভক্তি আর পাকিস্তান সৃষ্টির গালে সবচাইতে জোড়ালো চপেটাঘাত। পাশাপাশি এটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত ভারতের একমাত্র নিরঙ্কুশ বিজয়। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানী সেনা সদস্যের প্রকাশ্য দিবালোকে আত্মসমর্পণটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম আত্মসমর্পণ। পাশাপাশি পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসেও অন্যতম বৃহৎ আত্মসমর্পণের ঘটনা। বাংলাদেশ আর ভারতের ইতিহাসে এই যে সবচেয়ে গৌরবের অর্জনটি, তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল শুধু এই রাষ্ট্র দুটির সরকারগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে আর তাদের জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতায়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বর্বর কাপুরুষোচিত হামলা চালায় অপ্রস্তুত ভারতীয় সেনাবাহিনী আর বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। এতে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী সীতাকুন্ডে একটি ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশী ও ভারতীয় শহীদদের রক্তের মিলিত স্রোতধারায় যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশের সীতাকুন্ডে স্থাপিত ভাস্কর্যটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’। একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য অন্য একটি দেশের মানুষের অকাতরে জীবন দেয়ার এমন নজির পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। বাংলাদেশ এমনি একটি বিরল উদাহরণ। আর এই রাষ্ট্রটির জন্মের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ আর ভারত, এই দুই মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্রের ভবিতব্যটিও নির্ধারিত হয়ে গেছে। দেশে দেশে মৈত্রী কিংবা বৈরিতা নতুন কোন বিষয় নয়। আজ যারা মিত্র, কাল তারা বৈরী হতেই পারে। নিজ স্বার্থে দুই মিত্রের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টির চেষ্টাও থাকতে পারে তৃতীয় এক বা একাধিক পক্ষেরও। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বেলায়ও যে এর ব্যতিক্রম ঘটবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। তবে যা চোখ বুজেও বলে দেয়া যায়, তা হলো আমাদের মৈত্রিতে ফাটল ধরাতে অনেকের আগ্রহ যেমন থাকবে অনেক বেশি, তেমনি সম্পর্কের ফাটল অনেককে অনেক বেশি আহ্লাদিতও করবে। আমরা যদি তা হতে দেই তবে তা হবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিজয়। তা প্রমাণ করবে পাকিস্তান সৃষ্টির যৌক্তিকতা এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এটি হবে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়া ত্রিশ লাখ বাংলাদেশী আর হাজারো ভারতীয় শহীদের রক্তের প্রতি সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। একাত্তরে ১৬ ডিসেম্বর আরও একটি বিষয় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। আর তা হলো পৃথিবীতে যখন যে পরিস্থিতিতে যে সমীকরণই প্রযোজ্য হোক না কেন, একটি জায়গায় সেই সমীকরণটি অপরিবর্তিত থাকবে, আর তা হলো পাকিস্তানের জায়গাটিতে। গতকাল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন আমার প্রতি বৈরী ছিল, আজ তারা হয়ত তা নয়। তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর ভারতের যে সুসম্পর্ক, তা হয়ত আজকের জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিসের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ভারতের মৈত্রীর সঙ্গে মিলে যায় না। বৈশ্বিক ডিপ্লোমেসিতে, বিশেষ করে আজকের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর গ্লোবাল ভিলেজের বাস্তবতায় আর কোভিড প্যান্ডেমিকে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় এসবের কোন কিছুই অবাক করা কিছু নয়। এই কদিন আগেও যে আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব ছিল এককভাবে মার্কিনীদের হাতে, সেই জায়গাটা আজ চীনাদের কব্জায়। অথচ মোটা দাগে অপরিবর্তিতই আছে আফগানিস্তানে ভারত আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থের জায়গাগুলো। এটাই বৈশ্বিক বাস্তবতা। কিন্তু এই বৈশ্বিক বাস্তবতাটাই একেবারে ভিন্ন যখন বাংলাদেশ কিংবা ভারতের সামনে অপশনটি ‘পাকিস্তান’। বাঙালী আর ভারতীয় শহীদদের রক্তের মিলিত স্রোতধারা যেমন এই দুই দেশের মৈত্রীকে একটি জায়গায় বেধে ফেলেছে, তেমনি ঐ একই রক্তের উত্তরাধিকারের কারণেই আমাদের এই দুই রাষ্ট্রের কারোরই পাকিস্তানের প্রতি নূ্যূনতম ছাড় দেয়ার সামান্যতম সুযোগটিও নেই। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পারস্পরিক বন্ধন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের আগেই বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সেনাদের। স্বাক্ষরিত হয় ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি। গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন আর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ছিটমহল বিনিময়ের। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ’৭৫ পরবর্তী পাকিস্তানী ঘরানার জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদে এই সম্পর্কের ওপর বড় ধাক্কা আসে। বাংলাদেশকে পরিণত করা হয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনের অভয়ারণ্যে। এই দু’দেশের মৈত্রীময় সম্পর্কের আবারও সামনের দিকে চলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে। নৌ ও স্থল ট্রানজিট, রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি, ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদানের মতো একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ যেমন একদিকে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে এসেছে, অন্যদিকে ভারতও অমীমাংসিত স্থল ও সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ, বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে অংশগ্রহণ আর দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে একের পর এক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশকে কাছে টেনে নিয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা এই করোনাকালেও এই দুই প্রতিবেশীকে একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিভাত হতে দেখেছি। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, সহযোগিতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ও ভারত আগামীতে পৃথিবীর সামনে শুধু উন্নয়নের জন্যই নয়, বরং সুপ্রতিবেশী হিসেবেও পরিণত হবে রোল মডেলে। আজ যখন পঞ্চাশে বাংলাদেশ আর আমরা যখন ৬ ডিসেম্বর মৈত্রী দিবসে আমাদের দু’দেশে উদ্যাপন করছি আমাদের মৈত্রীর সুবর্ণজয়ন্তী, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আমরা কোন্্ জায়গায় দেখতে চাই। উত্তরটা খুবই সহজ। অতীতে আমরা হয়ত আমাদের ওপর লাখো শহীদের অর্পিত দায়িত্বটায় মাঝেসাঝেই বিস্মৃত হয়েছি। আর এর মাধ্যমে আমরা অন্য কাউকে নয়, নিজেরা খাটো করেছি নিজেদেরই বিশ্বের সামনে। সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তান এবং আমাদের দু’দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাকিস্তানী দালালগুলোর সামনে। এরপর যখন আমরা কখনও, কোনভাবে, কোন কারণে, তা সে যত তুচ্ছ বা অসামান্যই হোক না কেন, একে অপরের প্রতি অঙ্গুলি হেলনের চিন্তাটাও করব, তার আগে শুধু আমাদের দু’দেশের অনন্য সাধারণ সম্পর্কের এই অসাধারণ দিক দুটো একটু মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ আর ভারতের আজকের প্রজন্ম আর আগামীর নেতৃত্বের প্রতি আজকের এই অনন্য দিনটিতে এটুকুই প্রত্যাশা। লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×