ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শাহাজাহানের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলো সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শাহাজাহানের স্মৃতি বিজরিত স্থানগুলো সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ যুদ্ধে সম্মুখ সমরে লালনিরহাট জেলার প্রথম শহীদ ছাত্রলীগ নেতা শহীদ শাহাজাহান। স্বাধীনতা ৫০ বছরে পা রেখেছে। এরই মধ্যে শহীদের স্মৃতি বিজরিত স্থানটির চিহ্ন সুকৌশলে মুছে ফেলা হয়েছে। শহীদের স্বজনরা পায়নি শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি। পায়নি নূন্যতম সম্মান। সব হারিয়ে দেশ পেয়েছে। শুধু পায়নি আতœসম্মান ও আর্থিক ভাবে ঘুরের দাঁড়ানোর সুযোগ। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি পরিবারটি কোন রকম বেঁচে আছে। তাদের আতœত্যাগের ঘটনা সেই তিমিরে থেকে গেছে। রাষ্ট্রীয় কোন দিবসে পায়না দাওয়াত পত্র। পায়নি কোন সরকারি সহায়তা। এই প্রথম শহীদের কথা নতুন প্রজন্মের অজানা থেকে গেছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস উত্তাল সারা বাংলা। সেই ঢেউ পশ্চ্যাতপদ সীমান্তের লালমনিরহাট রেলকেন্দ্রীক শহরে এসেও আঁচড়ে পড়েছে।এই শহরটি অবিভক্ত ভারত বর্ষের একটি অত্যাধুনিক রেলওয়ে কেন্দ্রীক শহর ছিল। শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক হতেও এগিয়ে ছিল। তাই মানুষজন ছিল স্বাধীন চেতা। ৭ মার্চ ঢাকার বেডক্রস মাঠে জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ় কন্ঠে ঘোষনা দেয় - ”এবাবের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সেই সময়ের ৭ কোটি মানুষের প্রাণের কথা বঙ্গবন্ধু বলে ফেলেন। সেই সময় প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন তেমন ছিলনা। এক যাদুর ছোঁয়ায় মুহুর্তে প্রতিটি শহরে, বন্দরে, গ্রামে, অলিতে, গলিতেস্বাধীনতার মুলমন্ত্র সাধারণ মানুষের অন্তরে ” বেত বাক্যের” মত করে ঠাঁই পায়। পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারে করতে না দেয়ার চেষ্টা সমুখে ব্যর্থ হয়ে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মানুষকে গণ যুদ্ধের মূলমন্ত্রেরআকার ধারণ করে। যুবক, যুবমহিলা, ছাত্র-জনতা, শ্রমিক-মজুর, কৃষক, দিনমজুরসহ সকল শ্রেণির মানুষের রক্তে উম্মাদণা সৃষ্টি করে। পাড়া মহল্লায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে যুবকগণ। তারা মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় গোপন প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নেয়। শহীদ শাহাজাহানের বন্ধু লালমনিরহাট জেলা শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী দুলাল কর্মকার (৭২) জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ শাহাজাহান প্রথম বর্ষের লারমনিরহাট কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা একজনলালমনিরহাট শহরের ধনাঢ্য পাটের ব্যবসায়ি ছিল। পিতা আব্দুর রহমান কে সকলে দালাল হিসেবে এক নামে নিচনতেন। দালাল শব্দটি শুনতে কটু মনে হলেও সেই সময় পাটের যে সকল ব্যবসায়ি আদমজি জুট মিলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পাট ব্যবসায় মধ্যসত্ব ভুগি বড় ধরণের পাটের ব্যবসায়ি কে দালাদ বলা হয়ে থাকত। এটা বড় বড় ব্যবসায়িদের সুখ্যাতি হিসেবে ব্যবহার হয়ে ছিল। তিনি শুধু পাট নয়। নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যের কমিশনএজেন্ট ছিলেন। শহীদ শাহাজাহানছিল প্রতিবেশী ও সমবয়সি বন্ধু। লেখা পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। করতেন নিয়মিত সাহিত্য চর্চা। ৬৯ হতে ৭১’র শাহাজাহান শহীদ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত গান ও কবিতা লিখতেন। তার স¦রচিত গান কবিতা আন্দোলনের মাঠে নিজে পড়ে শুনাতেন। ছাত্র লীগের একজন স্বক্রিয় নেতা ও ধণাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সকলের প্রিয় মুখ ছিল। এক কথায় একজন খুব ভাল ছেলে ছিল। পাকিস্তান বিরোধী সকল আন্দোলন সংগ্রামের ছিল তার সরব উপস্থিতি। বীরমুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মী মোঃ আব্দুল ছালাম জানান, রেলওয়েতে চাকরি করার সুবাদে আমার কর্মস্থ ছিল রেলওয়ে পাওয়ার হাউজ। এর আশেপাশেই ছিল সেই সময়ে লালমনিরহাটের রাজনীতির তীর্থস্থান। এখানে প্রায় সকাল সন্ধ্যা টকবগে যুবক শাহাজানকে দেখতাম। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে যাই। সত্যকথা কি শহীদ শাহাজাহানের মৃত্যু এই শহরের প্রতীবাদী মানুষকে পাকিস্তান বিরোধী শক্তি যুগিয়েছে।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানীরা নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালি পুলিশ সদস্যদের উপর আক্রমণ করে বসে। পুলিশ সদস্যরা প্রথম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গৌরবের প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলে। প্রতিরোধ যুদ্ধেঅকাতরে প্রাণ হারায় পুলিশ সদস্য গণ। মূলত সেইদিন হতে শুরু হয় জনযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ বা পাকিস্তানিদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই বর্বর হত্যাকান্ডের ঘটনা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয়ে যায় পাড়া,মহল্লা,শহর, বন্দর, গ্রামে প্রতিবাদ সমাবেশ। সারা দেশের ন্যায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ লালমনিরহাটের মফস্বল শহর অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। আকাশ বাণী কলকাতা, বিবিসি (বাংলা) রেডিও ষ্টেশনের খবর শুনে সাধারণ মানুষ প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সকলে নিশ্চিত হয়ে যায়। তাঁকে মুক্ত করতে হবে। তাঁকে মুক্ত করতে হলে দেশ স্বাধীন করতে হবে। তখন উত্থাল সারাদেশ। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভালবাসায় মানুষের মনে উম্মাদনা সৃস্টি হয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশএকই স্বত্বা সৃষ্টি করে ছিল। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার ও পুলিশ লাইনে গণ হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীগণ২৭ মার্চ লালমনিরহাট শহরে ঝটিকা মিছিল বাহির করে। মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করতে করতে রেলওয়ে বিডিআর গেট সংলগ্ন তৎকালীন রেলওয়ে অবাঙ্গালি বিহারি অধূষ্যিতআপ ইয়ার্ড কলোনিতে চলে আসে। লক্ষ্য তারা বিহারিদের হাতে থাকা আগ্নেয়োস্ত্র সংগ্রহনিবে। সেই দিনঅবাঙ্গালি বিহারি অধুষ্যিত আপ ইয়ার্ড কলোনিতে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। বাঙ্গালি ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলটিতে বিহারীরা এলোপাতারি বেপোরয়া বৃষ্টিরমত গুলি ছোঁড়তে থাকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছাত্ররা কলোনির পাশে রেল রাইনের নিচু ঢালে আশ্রয় নেয়। সেই সময়টি ছিল ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বিকাল ৪ টা। সেই সময় হঠাৎ কলেজ ছাত্র শাহাজাহানের বুকে বিহারীরা এক রাউন্ড গুলিচালায়। বুলেট বিদ্ধ হয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে শাহাজাহান। এই জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হয় জাহাজাহান। হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে হাজার হাজার ছাত্র জনতার ¯্রােত আপ ইয়ার্ড কলোনিতেএসে হামলে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়আপ ইয়ার্ড কলোনিতে। শহীদ শাহাজাহানের মৃতদেহ একদিন ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল। পরে লাশ পুলিশ লালমনিরহাট থানায় নিয়ে আসে। থানা চত্বরে অবহেলায ফেরে রাখা হয়। দুইদিন পর প্রতিবেশীরা থানা পুলিশের কাছ হতে লাশ নিয়ে এসে বাড়ির পাশে পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করে। বর্তমানে গর্বিত মা-বাবার সমাধির মাঝখানে শহীদ শাহাজাহানের কবরটি রয়েছে। অবাঙ্গালি ও বেহারিরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। তবে তাদের নিরাপদ আশ্রয় কিন্তু দেয় বাঙ্গালিরা। সেই দিনের ঘটনার পর বিহারী বাঙ্গালি ঐক্য কমিটি গঠন করে। বিহারিরা শ্লোগান দেয় বিহারী বাঙ্গালি ভাইভাই। দেশ রক্ষায় একসাথে লড়ব তাই। বিহারীরা কথা রাকেনি। পাকি সেনাদের তারা স্বাগত জানায়। পাখি সেনারা শহরে অবস্থান নিরে বিহারীরা ভযংকর হয়ে উঠে। এভাবে বাঙ্গালিরা পাখিদের বিরুদ্ধে লালমনিরহাটে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এই আপ ইয়ার্ড কলোনির ঘটনার পর বংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টমেন্ট হতে পাকিস্তানীসাজোয়া যান নিয়ে লালমনিরহাট শহরে প্রবেশ করে পাখি বাহিনী। তারা হাড়িভাঙ্গা পরিত্যক্ত ইয়ারপোর্ট, রেলওয়ে ট্রেনিং স্কুল, রেলওয়ে অফিসার ক্লাব (নাচ ঘর নামে পরিচিত)মাঠসহ শহরের বেশ কয়টি স্থানে সেনা ছাউনি স্থাপন করে। সেই দিনেরপর দিনরাত্রি নির্বিচারে নিরীহ সাধারণ মানুষকে পাখির মত গুলি করে হত্যা করা শুরু হয়ে যায়।সেই নারকীয় হত্যার স্মৃতি চিহ্নি জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাখি সেনাদের ভিকটিম হতে হয় রেলওয়ে কলোনিতে বসবাসরত নর-নারীদের। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ( সাবেক) বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজবা উদ্দিন জানান, আপইয়ার্ড কলোনি ছিল বিহারী অধূষ্যিত একটি বস্তি। রেলওয়ে লোকসেডে কর্মচারিরা এখানে গিনছি পরিবেশে বসবাস করত। সেই আপইয়ার্ড কলোনির সামনের রাস্তা দিয়ে বাঙ্গালিরা যেতে পারত না। বেহারিরা বাঙ্গালিকদের যেত দিত না। বাঙ্গালিরা বাধ্য হয়ে একটু অদুরে বিকল্প কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাতাযাত করত। বৈষম্য করে ছিল বেহারিরা। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে। গণ আন্দোলনে বিহারিরা বাঙ্গালিদের সাথে ঐক্য রেখে সমঝোতা করে চলছে। বাঙ্গালিরা কোন বেহারির ক্ষতি করতে দেয়নি। পরবর্তীতে পাখি সেনারা শহরে ঢুকলে বিহারিরা নিজের স্বওুপে ফিরে তান্ডব করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার পর সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে। শহীদ শাহাজাহান সেই প্রতিহিংসার স্বীকার হয়েছে। মহানমুক্তিযুদ্ধের পর রেলওয়ে আপ ইয়ার্ড কলোনির নাম পরিবর্তন করে রাকা হয় শহীদ শাহাজান কলোনি। রেল লাইনে ধারে যেখানে বুলেট বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মারা যায় ছাত্র শাহাজাহান। সেই শহীদ শাহাজাহান গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে পাঁকা সেনেটারি ল্যান্টিন নির্মাণ করে সুকৌশলে শহীদ শাহাজাহান কে অসম্মান করা হয়েছে। এই পৌরসভার গণ শৌচাগারটি নির্মাণ করেছে পৌর কতৃপক্ষ। গণ শৌচাগারটির পাশে জনৈক ব্যক্তির নামে কওমি মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। গণ চৌচাগার লিখা থাকলেও সেটা ব্যবহার করছে শুধুমাত্র কওমি মাদ্রাসার টয়লেট হিসেবে। মাদ্রাসাটি বন্ধ থাকে। আসলে রেলওয়ে জমি অবৈধ দখলে রাকার কৌশল এটি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শাহাজাহানের কোন স্মৃতি চিহ্ন সেখানে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর পর রেলওয়ে ষ্টেশনে বিহারিদের রেখে যাওয়া ছোট একটি ফাঁকা দোকান ঘর শহীদ জাহাজাহানের পরিবারকে দেয়া হয়ে ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তাও দখল করে নিয়েছে রাজনৈতিক কর্মীরা। শহীদ শাহাজাহানের মৃত্যুর পর ধনাঢ্য পাট ব্যবসায়ি বাবার উপর পাকিস্তানিরা নির্যাতন করে। তারা প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে ভারতে চলে যায়। পাটের গোডাউন ঘর বাড়ি লুটপাট করে পাখি সেনা আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহুর্তে পথে বসে যায় পরিবারটি। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে এলেও পরিবারটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। জেলা প্রথম শহীদ শাহাজাহান সম্পর্কে তরুণ ও নতুন প্রজন্মকে জানাতে নানা উদ্যোগ নেয়ার দাবি উঠেছে। সেই সাথে শহীদ শাহাজাহানের পরিবারটিকে শহীদ পরিবারের সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার দাবি উঠেছে।
×